ব্যুরো নিউজ ৩০ মে : আলিপুরদুয়ারের মাটি সাক্ষী থাকলো এক বিরাট পরিবর্তনের সঙ্কল্পের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদারের ঝাঁঝালো বক্তব্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’ থেকে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’ – স্লোগান, অঙ্গীকার আর আক্রমণের ধারালো বাক্যবাণে সরগরম হলো মঞ্চ।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর উন্নয়নের বার্তা ও তৃণমূলের প্রতি তীব্র আক্রমণ
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণের শুরুতেই আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারের জন্য ₹১,০১০ কোটি টাকার সিটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন (CGD) প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। তিনি এই প্রকল্পকে “সরকারের দোরগোড়ায় পরিষেবা” পৌঁছে দেওয়ার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্যে ভারতের শক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রসঙ্গ উঠে আসে, যেখানে ২০১৪ সালের ৬৬টি জেলার তুলনায় বর্তমানে ৫০০টিরও বেশি জেলায় সিটি গ্যাস নেটওয়ার্ক পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনার মাধ্যমে ৩১ কোটিরও বেশি এলপিজি সংযোগ দেওয়ার সাফল্যের কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
তবে, মোদীর প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি এবং অরাজকতা । তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন:
- “বাংলার হিংসা, দুর্নীতি, দাঙ্গা এবং তুষ্টিকরণের রাজনীতি থেকে স্বাধীনতা দরকার।”
- “পশ্চিমবঙ্গ সব দিক থেকে সংকটে ভুগছে। প্রথমত, সমাজে ছড়িয়ে পড়া হিংসা ও অরাজকতার সংকট। দ্বিতীয়ত, আমাদের মা-বোনেরা অনিরাপদ এবং জঘন্য অপরাধের শিকার হচ্ছেন। তৃতীয়ত, তরুণদের মধ্যে চরম হতাশা এবং ব্যাপক বেকারত্ব। চতুর্থত, ব্যবস্থার উপর আস্থার ধারাবাহিক পতন। এবং অবশেষে, শাসক দলের স্বার্থপর রাজনীতি দরিদ্রদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।”
- “কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক সামাজিক প্রকল্প, যেমন আয়ুষ্মান ভারত এবং প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, পশ্চিমবঙ্গে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।”
তিনি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং মুর্শিদাবাদ-মালদার সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্য রাজ্য সরকারকে দায়ী করে বলেন:
- “মুর্শিদাবাদ এবং মালদায় যা ঘটেছে তা এখানকার রাজ্য সরকারের নির্মমতার একটি উদাহরণ। তুষ্টিকরণের নামে গুন্ডামিকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। এইখানে হিন্দুদের বাড়ি ঘর দোকান সমস্ত চিহ্নিত করে আক্রমণ করা হয়েছিল “
- “এখানে প্রতিটি বিষয়ে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। তা না হলে কিছুই সমাধান হবে না। বাংলার মানুষ এখন তৃণমূল সরকারের উপর আস্থা রাখে না।”
‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি
প্রধানমন্ত্রী পহেলগাঁও হামলার প্রসঙ্গ টেনে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এটি কেবল ভারতের উপর আক্রমণ ছিল না, মানবতা এবং ভ্রাতৃত্বের উপরও আক্রমণ ছিল। তিনি পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার জন্য তীব্র সমালোচনা করেন:
- “পহেলগামে সন্ত্রাসবাদীরা যা করেছে তা শুধু ভারতের উপর আক্রমণ ছিল না, মানবতা এবং ভ্রাতৃত্বের উপরও আক্রমণ ছিল। সন্ত্রাসবাদীরা ভারতের অনেক পরিবারের সুখ কেড়ে নিয়েছে।”
- “ভারত এখন আগের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। সন্ত্রাসবাদীদের আস্তানা ধ্বংস হওয়ার পর হতাশ হয়ে পাকিস্তান ভারতের বেসামরিক নাগরিক ও সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে।”
- “পাকিস্তান, যারা সন্ত্রাসবাদকে লালন করে, তাদের বিশ্বের কাছে ইতিবাচক কিছু দেওয়ার নেই। সন্ত্রাসবাদ এবং ব্যাপক হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে বড় দক্ষতা; যখনই যুদ্ধ হয়, তারা পরাজিত হয়।”
শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্কল্প ও ২০২৬-এর সংগ্রাম
প্রধানমন্ত্রীর জনসভার আগে মঞ্চে শুভেন্দু অধিকারীও সুর চড়ান। তিনি নরেন্দ্র মোদীকে “ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী” আখ্যা দেন এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্যের জন্য তাঁর প্রশংসা করেন। শুভেন্দু অধিকারীর আক্রমণের কেন্দ্রে ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
- “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের সিঁদুর মুছতে ভালবাসেন। হরগোবিন্দ দাস, চন্দন দাসের স্ত্রীদের সিঁদুর তো উনিই মুছেছেন। ওনার মেহবুব আলম মুছেছেন। মোদীজির সঙ্গে লড়তে হবে না।”
- “আমিই (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে) হারিয়েছি। ছাব্বিশে আবার হারাব।”
- “মোদি গঙ্গা আর উনি কালীঘাটের নালা।”
- “প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে আক্রমণ করলেন তার উত্তর বাংলার মানুষ দিয়ে দেবে। ২৬ সালে বাংলার মানুষ প্রাক্তন করে দেবে।”
দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল সরকারকে সরানোর বিষয়ে তাঁর সংকল্প ছিল স্পষ্ট:
- “বাংলায় তোষণের রাজনীতি করছে দুর্নীতিগ্রস্ত, হিন্দুবিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস।”
- “বিধানসভা ভোটে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রবাদী সরকার তৈরি করতে হবে।”
- “হিন্দু বিরোধী সরকারকে উপড়ে ফেলতে হবে।”
- “মমতা এবং ভাইপোর সরকারকে উপড়ে ফেলতে হবে।”
- “আমি যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে পারি আপনারাও পারবেন।”
মঞ্চে প্রবেশের আগে শুভেন্দু অধিকারীর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করার দৃশ্যটিও সনাতনী সংস্কৃতি মেনে শ্রদ্ধার প্রকাশ হিসেবে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে।
সুকান্ত মজুমদারের ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’-এর ডাক
রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার তাঁর বক্তব্যে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’ (Operation West Bengal) চালানোর ঘোষণা করে বিতর্কের জন্ম দেন। তিনি ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর উদাহরণ টেনে বলেন:
- “মা-বোনেদের মাথার সিঁদুর পাকিস্তান মিটিয়েছিল। তার বদলা নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। আমার সামনে হাজার হাজার সংখ্যায় বিজেপি কর্মকর্তারা আগামী দিনে অপারেশন সিঁদুরের মতো মোদীজির সৈনিক হয়ে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’ করে তৃণমূলকে উৎখাত করে বঙ্গোপসাগরের জলে ফেলবে।”
- “অপারেশন সিঁদুরের মতোই আমরা, বিজেপির সেনারা এবার অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ চালাবো এবং তৃণমূলকে উৎখাত করবো।”
মুর্শিদাবাদে সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন:
- “আমি মুর্শিদাবাদে সম্প্রতি গিয়েছিলাম এবং দেখেছি কিভাবে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের একমাত্র দোষ ছিল সিঁদুর পরা এবং তুলসীর মালা পরা। কাশ্মীর আর মুর্শিদাবাদ এখন এক হয়ে গেছে।”
- “আমাদেরকে ২০২৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে উপড়ে ফেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলতে হবে।”
শিক্ষক নিয়োগ থেকে রেশন দুর্নীতি, পঞ্চায়েত ভোট থেকে সন্দেশখালি – রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে উঠে আসা লাগাতার দুর্নীতি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগগুলি এই জনসভায় বিজেপির মূল ভিত্তি ছিল। ‘নির্মম সরকার’ এবং ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’-এর মতো শব্দবন্ধগুলি নিশ্চিতভাবে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দেবে, যেখানে বিজেপির মূল বার্তা রাজ্যের তৃণমূল সরকার কর্তৃক সৃষ্ট অরাজকতা, দুর্নীতি এবং জন-নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তির। বাংলার মাটি থেকে বারবার শোনা যাচ্ছে যে, জনগণ এই “নির্মম সরকার” থেকে মুক্তি চাইছে, এবং বিজেপি সেই পরিবর্তনের সঙ্কল্পই পুনর্ব্যক্ত করল।