ব্যুরো নিউজ ৪ জুন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক জৈব প্যাথোজেন (রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু) পাচারের অভিযোগে ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের এক চীনা গবেষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা এই ঘটনাকে ‘কৃষি-সন্ত্রাসবাদের’ গুরুতর হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এফবিআই (FBI) পরিচালক কাশ প্যাটেল (Kash Patel) সামাজিক মাধ্যমে এই গ্রেফতারের খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, ইউনকিং জিয়ান (Yunqing Jian) নামের ওই গবেষক ‘ফুসারিয়াম গ্রামিনিয়ারাম’ (Fusarium graminearum) নামক একটি বিষাক্ত ছত্রাক অনুমতি ছাড়াই দেশে নিয়ে এসেছিলেন। এই ছত্রাক গম, ভুট্টা, ধান এবং যবসহ প্রধান খাদ্যশস্যের ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম এবং গবাদি পশু ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষজ্ঞরা এই প্যাথোজেনকে একটি সম্ভাব্য ‘কৃষি-সন্ত্রাসী অস্ত্র’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
অভিযুক্ত গবেষক দম্পতি ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
৩৩ বছর বয়সী ইউনকিং জিয়ান এবং তার প্রেমিক ৩৪ বছর বয়সী জুনইয়ং লিউ (Zunyong Liu)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, চোরাচালান, ভিসা জালিয়াতি এবং মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। লিউ পূর্বে একই বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবে কাজ করতেন এবং বর্তমানে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
ফসলের ব্যাপক ক্ষতি ও মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি
এফবিআই জানিয়েছে, এই ছত্রাক ফসলে ‘হেড ব্লাইট’ (Head Blight) নামক এক ধরনের রোগ সৃষ্টি করে, যা গম, ভুট্টা, যব এবং ধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্যকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর শত শত কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এফবিআই যোগ করেছে, এই ছত্রাক থেকে নির্গত বিষ (মাইকোটক্সিন) মানুষ এবং গবাদি পশু উভয়ের মধ্যেই বমি, যকৃতের ক্ষতি এবং প্রজননগত ত্রুটি ঘটাতে পারে। ফলস্বরূপ, খাদ্য শৃঙ্খলে এর প্রবেশ মানব স্বাস্থ্যের জন্য চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে।
অনুমোদনহীন গবেষণা ও গোপন ষড়যন্ত্র
মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস, ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের যে গবেষণাগারে জিয়ান কাজ করতেন, সেখানে এই ধরনের উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ প্যাথোজেন নিয়ে কাজ করার জন্য কোনো ফেডারেল অনুমোদন ছিল না। মঙ্গলবার প্রকাশিত এক ফেডারেল অভিযোগে বলা হয়েছে, জিয়ান প্রয়োজনীয় মার্কিন ফেডারেল অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পাসের একটি ল্যাবরেটরিতে এই ছত্রাক চাষ করছিলেন। এফবিআই জানিয়েছে যে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে লিউ ডেট্রয়েট মেট্রোপলিটন বিমানবন্দর দিয়ে একটি লাল রঙের উদ্ভিজ্জ উপাদান তার ব্যাকপ্যাকে লুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন। প্রথমে তিনি এই পদার্থ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান অস্বীকার করলেও, পরে স্বীকার করেন যে এটি একই ছত্রাক এবং জিয়ানের ল্যাবে গবেষণার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিল। শুল্ক কর্মকর্তারা লিউকে চীনে ফেরত পাঠালেও, ততক্ষণে সন্দেহ তীব্র আকার ধারণ করে।
আদালতের নথি থেকে জানা যায়, জিয়ান এবং লিউয়ের মধ্যে কয়েক মাসের যোগাযোগের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জিয়ানের একটি বার্তায় লেখা ছিল, “দুঃখজনক যে আমাকে এখনও তোমার জন্য কাজ করতে হবে।” জবাবে লিউ লিখেছিলেন: “একবার এটা হয়ে গেলে, সবকিছু সহজ হয়ে যাবে।”
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিয়ানের ল্যাবে এফবিআই-এর পরিদর্শনের পর আরও তদন্ত শুরু হয়। জিয়ান প্রথমে কোনো জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, তার ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (CCP) প্রতি আনুগত্যের একটি স্বাক্ষরিত বিবৃতি এবং লিউয়ের ব্যর্থ প্রবেশের চেষ্টার আগেও তিনি এই ছত্রাক নিয়ে কাজ করছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায়।
এশিয়ায় কোভিড বৃদ্ধি: কারণ ও নতুন উপসর্গ জানালেন চিকিৎসকরা
জাতীয় সুরক্ষার উদ্বেগ: চীনা তহবিল ও CCP-এর সংশ্লিষ্টতা
ফেডারেল প্রসিকিউটররা জানিয়েছেন যে, জিয়ান পূর্বে এই প্যাথোজেন নিয়ে কাজ করার জন্য চীনা সরকারের কাছ থেকে তহবিল পেয়েছিলেন এবং তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একজন ঘোষিত সমর্থক। মার্কিন অ্যাটর্নি জেরোম গর্গণ জুনিয়র (Jerome Gorgon Jr.) বলেছেন, “এই চীনা নাগরিকদের, যার মধ্যে একজন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অনুগত সদস্যও রয়েছেন, তাদের কথিত কার্যকলাপ জাতীয় সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।”
এফবিআই পরিচালক প্যাটেল এই মামলাটিকে CCP-এর আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলিতে অনুপ্রবেশ এবং কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলিকে লক্ষ্য করার প্রচেষ্টার একটি “গুরুত্বপূর্ণ অনুস্মারক” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, “এই ছত্রাক বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর শত শত কোটি ডলারের ফসল ক্ষতির জন্য দায়ী। এই ধরনের একটি লঙ্ঘন খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবন উভয়কেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।”
বর্তমানে লিউ চীনে রয়েছেন এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করা অসম্ভব, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। জিয়ান বৃহস্পতিবারের জামিন শুনানির আগ পর্যন্ত মিশিগানে হেফাজতে রয়েছেন। এই ঘটনা বিজ্ঞান, জাতীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।