ব্যুরো নিউজ ১৩ অক্টোবর ২০২৫ : আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিল্লি সফরের সময় নারী সাংবাদিকদের প্রেস কনফারেন্সে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র এবং অন্যান্য বিরোধী নেতৃত্ব। এই ঘটনাকে তাঁরা ভারতের মূল্যবোধের পরিপন্থী এবং ‘জাতীয় লজ্জা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
নারী সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা, মহুয়া মৈত্রর আক্রমণ
শনিবার দিল্লিতে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাংবাদিক সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের ঢুকতে না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। তিনি ‘এক্স’-এ একটি ভিডিও পোস্ট করে এই ঘটনাকে “ভয়ানক” আখ্যা দেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রকের (MEA) কড়া সমালোচনা করেন।
মুত্তাকি তালেবান সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা এবং আফগানিস্তানে নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে গুরুতর বিধিনিষেধ আরোপকারী নীতিগুলির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পরিচিত।
মহুয়া মৈত্র বলেন, “ভারতের মাটিতে এই ঘটনা ঘটেছে। এই তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেড কার্পেট সংবর্ধনা পেয়েছেন, যার স্পর্ধা হয়েছে প্রেস কনফারেন্সের ঘর থেকে নারীদের সরিয়ে দিতে বলা, আর আমাদের সরকার তাঁকে আনুষ্ঠানিক মর্যাদা ও প্রোটোকল দিচ্ছে।”
তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত পুরুষ সাংবাদিকদের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “প্রত্যেক পুরুষ সাংবাদিক যিনি এই প্রেস কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিলেন, তিনি একটিও প্রতিবাদের শব্দ উচ্চারণ করেননি। আপনারা কি পুরুষত্বহীন? আপনারা কি মেরুদণ্ডহীন?”
সরকারের ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি অভিযোগ করেন, “আপনারা করদাতাদের টাকায় এমন একটি সরকারি প্রতিনিধিদলকে প্রোটোকল এবং লাল গালিচা সংবর্ধনা দিচ্ছেন, যারা ভারতের মাটিতে আমাদের মূল্যবোধকে অসম্মান করছে এবং নারীদের ঘর থেকে সরে যেতে বলছে।”
Afghanistan : ভারতের পাশে আফগানিস্তান? আফগানিস্তানের মাটিতে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানের বিমান হামলা !
সরকারকে তুলোধোনা করলেন রাহুল, প্রিয়াঙ্কা, চিদম্বরম
এই ঘটনায় দেশের একাধিক বিরোধী নেতা সরব হয়েছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে বলেন, “যখন আপনি একটি পাবলিক ফোরাম থেকে নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার অনুমতি দেন, তখন আপনি ভারতের প্রতিটি নারীকে বলছেন যে আপনি তাদের পক্ষে দাঁড়াতে খুব দুর্বল।” তিনি আরও বলেন, এই নীরবতা ‘নারী শক্তি’ নিয়ে সরকারের স্লোগানের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ করে।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরা প্রধানমন্ত্রীকে এই বিষয়ে “অবস্থান স্পষ্ট” করার দাবি জানিয়ে বলেন, “আমাদের দেশে দেশের মেরুদণ্ড ও গর্ব—এমন কিছু সবচেয়ে দক্ষ নারীর এই অপমান কীভাবে সহ্য করা হলো?”
সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদম্বরম মন্তব্য করেন, যখন পুরুষ সাংবাদিকরা জানতে পারলেন যে নারী সাংবাদিকদের অনুমতি দেওয়া হয়নি, তখন তাঁদের উচিত ছিল অনুষ্ঠান থেকে ওয়াকআউট করা।
তালিবান মন্ত্রীর স্বিকারক্তি : ‘কারিগরি ত্রুটি’
ব্যাপক সমালোচনার মুখে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি রবিবার আরও একটি প্রেস কনফারেন্স করেন এবং এবার নারী সাংবাদিকদেরও আমন্ত্রণ জানান। তিনি প্রথম দিনের ঘটনাকে “কারিগরি ত্রুটি” (technical issue) বলে ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, অনুষ্ঠানটি স্বল্প সময়ের নোটিশে হওয়ায় আমন্ত্রিতদের একটি নির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। তাঁর দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়, এর পেছনে লিঙ্গ বৈষম্যের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।
ভারত সরকার এই বিতর্কের মধ্যে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্মকর্তারা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, দিল্লিতে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজনে তাদের কোনো ‘সম্পৃক্ততা ছিল না’।
মুত্তাকি আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমানে ১ কোটি শিক্ষার্থী স্কুলে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নথিভুক্ত আছে, যার মধ্যে ২৮ লক্ষ মেয়ে। তিনি বলেন, কিছু এলাকায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এর অর্থ এই নয় যে তারা শিক্ষার বিরোধী। তাঁর কথায়, “আমরা এটিকে ধর্মীয়ভাবে ‘হারাম’ (পাপ) ঘোষণা করিনি, তবে দ্বিতীয় নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এটি স্থগিত রাখা হয়েছে।”
রাজনৈতিক আখ্যান এবং বিতর্কের মোড়
গোটা ঘটনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, ভারতে আগত আফগান বিদেশমন্ত্রীর নিজস্ব সূচি ঘিরে একটি রাজনৈতিক বিতর্কের পরিস্থিতি তৈরি করার প্রচেষ্টা চলছে। ভারতের বেশ কিছু বিরোধী দল, যাদের বাংলাদেশে হিন্দু নারী নির্যাতনের ঘটনায় এবং পশ্চিমবঙ্গে বেড়ে চলা নারী ধর্ষণের ক্ষেত্রে নীরবতা লক্ষণীয় , তাদের হঠাৎ সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তানের বিদেশমন্ত্রীর নিজস্ব সূচি এবং সাংবাদিক তালিকা নিয়ে। এই আফগান রাষ্ট্রদূতের ভারত সফরের বিরোধিতা ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানও করছে এবং ভারতের কিছু বিরোধী দলের অবস্থান একই এক্ষেত্রে । তবে আফগান বিদেশ মন্ত্রী তাদের অজ্ঞতা স্বীকার করে, দায়িত্ববান অতিথির মতো তাদের সূচিতে বদল আনেন এবং মহিলা সাংবাদিকদের সামনেও নিজেদের সাংবাদিক বিবৃতি দেন , যেখানে ভারত-আফগান মৈত্রীর প্রতি আফগানিস্তানের উৎসাহ এবং সদিচ্ছা স্পষ্ট হয় ।