ব্যুরো নিউজ ০৮ অক্টোবর ২০২৫ : এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পটপরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে তালিবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ৯ অক্টোবর ভারত সফরে আসছেন। ২০২১ সালের আগস্টে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর এই প্রথম কাবুল থেকে এত উচ্চ-পর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি নয়াদিল্লি আসছেন। এই সফরের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ৯ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত মুত্তাকিকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থেকে অস্থায়ীভাবে অব্যাহতি দিয়েছে, যা এই সফরের আঞ্চলিক গুরুত্ব তুলে ধরে।
দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি ও মন্ত্রী-পর্যায়ের প্রথম যোগাযোগ
ভারতীয় কূটনৈতিক মহল গত কয়েক মাস ধরে এই সফরের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জানুয়ারি মাস থেকে ভারতীয় কর্মকর্তারা, যার মধ্যে বিদেশ সচিব বিক্রম মিসরিও ছিলেন, দুবাইয়ের মতো নিরপেক্ষ স্থানে মুত্তাকি এবং অন্যান্য তালিবান নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেছেন।
বিশেষত মে মাসে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ‘অপারেশন সিন্দূর’-এর পর ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মুত্তাকির সঙ্গে কথা বলেন, যা ২০২১ সালের পর প্রথম মন্ত্রী-পর্যায়ের যোগাযোগ ছিল। সেই কথোপকথনে জয়শঙ্কর পাহালগাঁও সন্ত্রাসবাদী হামলার নিন্দা করার জন্য তালিবানকে ধন্যবাদ জানান এবং আফগান জনগণের সাথে ভারতের “ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বের” কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
সন্ত্রাসবাদের নিন্দা: অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যের ইঙ্গিত
এর আগে এপ্রিল মাসে, কাবুলে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তালিবান জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগাঁও সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা করেছিল। এই বিবৃতিকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখা হয়, যা ইঙ্গিত দেয় যে ভারত এবং আফগানিস্তান পাকিস্তান-পৃষ্ঠপোষক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একমত। এরপর থেকেই নয়া দিল্লি আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি খাদ্য, ওষুধ এবং অবকাঠামো সহায়তা বাড়িয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, সাম্প্রতিককালে লস্কর কমান্ডার এবং আইএসআইএস খোরাসান মডিউল-এর মধ্যে সদ্ভাব বিনিময় সংক্রান্ত খবর ও ছবি সামনে এসেছে। আইএসকেপি-র উত্থানের ফলে তালিবান প্রশাসন এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী উভয়েই একই ধরনের সন্ত্রাসবাদী হুমকির সম্মুখীন। এই সফরে পাকিস্তান-পৃষ্ঠপোষক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় নিরাপত্তা জোট এবং সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি ও কৌশলগত প্রভাব
আফগানিস্তানে গত সেপ্টেম্বরের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর ভারত প্রথম দিকের কয়েকটি দেশের মধ্যে ছিল যারা দ্রুত সাড়া দেয় এবং ১,০০০ পারিবারিক তাঁবু এবং ১৫ টন খাদ্য সামগ্রী পাঠায়। এর কিছুদিন পরই ওষুধ, স্বাস্থ্যবিধি কিট, কম্বল এবং জেনারেটর সহ অতিরিক্ত ২১ টন ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়। ২০২১ সালে তালিবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে ভারত আফগানিস্তানে প্রায় ৫০,০০০ টন গম, ৩৩০ টনেরও বেশি ওষুধ ও টিকা, ৪০,০০০ লিটার কীটনাশক এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করেছে, যা গুরুতর কষ্টের সম্মুখীন হওয়া লক্ষ লক্ষ আফগানকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছে।
মুত্তাকির এই সফরকে পাকিস্তানের জন্য একটি কূটনৈতিক ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ ইসলামাবাদ ঐতিহ্যগতভাবে কাবুলের উপর শক্তিশালী প্রভাব বজায় রেখেছিল। এ বছর পাকিস্তান যখন ৮০,০০০-এরও বেশি আফগান শরণার্থীকে ফেরত পাঠায়, তখন ইসলামাবাদ এবং তালিবানের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়, যা ভারতের জন্য তার ভূমিকা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে দেয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর কাবুলের পররাষ্ট্র সম্পর্ককে বহুমুখী করার এবং পাকিস্তানের উপর নির্ভরতা কমানোর ইচ্ছাকে তুলে ধরে। ভারতের জন্য, তালিবানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ তার নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষা, সন্ত্রাসবাদী হুমকি মোকাবিলা এবং এই অঞ্চলে চীন ও পাকিস্তানের প্রভাবের ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ।




















