ব্যুরো নিউজ ০৩ অক্টোবর ২০২৫ : উত্তরপ্রদেশের বরেলিতে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ পোস্টার বিতর্কের জেরে সৃষ্ট সহিংসতা এবং উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবারও নিরাপত্তা জোরদার রাখা হয়েছে। উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কর্তৃপক্ষ কংগ্রেস নেতা ইমরান মাসউদ এবং প্রাক্তন সাংসদ দানিশ আলীকে বরেলি পরিদর্শনের আগেই বুধবার গৃহবন্দী করেছে।
বরেলি সহিংসতা এবং এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে ।
কংগ্রেস নেতাদের গৃহবন্দী ও পরিস্থিতি পরিদর্শনের চেষ্টা
সাহারানপুরে কংগ্রেস নেতা ইমরান মাসউদকে এবং আমরোহায় প্রাক্তন সাংসদ দানিশ আলীকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ গৃহবন্দী করেছে। মাসউদ একটি কংগ্রেস প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল, যা বরেলির ডিআইজির সাথে দেখা করে শুক্রবারের সহিংসতার পরের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার কথা ছিল। তবে, নিরাপত্তা উদ্বেগ ও বর্তমান আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ স্থান থেকে বরেলি যাওয়া থেকে বিরত রাখে।
সহিংসতার কারণ ও পুলিশের পদক্ষেপ
গত ২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবারের নামাজের পর বরেলিতে হিংসাত্মক বিক্ষোভ শুরু হয়। বিতর্কিত “আই লাভ মুহাম্মদ” বার্তা সম্বলিত একটি বারাবফাত পোস্টার নিয়ে কানপুরে এফআইআর দায়ের হওয়ার পর এই বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়।
বিক্ষোভটি শুরু হয় যখন ধর্মীয় ব্যানার হাতে এবং স্লোগান দিতে দিতে ১,০০০-এরও বেশি লোক ইসলামিয়া গ্রাউন্ডের কাছে জড়ো হয়, যার ডাক দিয়েছিলেন ধর্মীয় নেতা মাওলানা তৌকির রাজা খান। পুলিশ জানায়, ভিড়ের একাংশ পাথর ছোঁড়া, গাড়ি ভাঙচুর এবং শূন্যে গুলি চালানো শুরু করলে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে হয়, যার ফলে পদদলিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই সহিংসতায় অন্তত ১০ জন পুলিশ কর্মী আহত হয়েছেন।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই সহিংসতার নিন্দা করে কঠোর ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন।
গ্রেপ্তার ও ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত
সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৮১ জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার মধ্যে মাওলানা তৌকির রাজা খানও রয়েছেন। পুলিশ একাধিক থানায় এফআইআর নথিভুক্ত করেছে এবং ভিডিও ফুটেজ ও ফোন রেকর্ড খতিয়ে দেখে অতিরিক্ত সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। উত্তর প্রদেশ পুলিশ ইটতেহাদ-এ-মিল্লাত কাউন্সিল (IMC)-এর জাতীয় সাধারণ সম্পাদক নাফিস খান এবং তাঁর ছেলে ফারমান খানকেও গ্রেপ্তার করেছে, যাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
গুজব ছড়ানো এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দেওয়া রোধ করার জন্য বরেলি জেলায় ২ অক্টোবর বিকেল ৩টা থেকে ৪ অক্টোবর বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার জন্য মোবাইল ইন্টারনেট, ব্রডব্যান্ড এবং এসএমএস পরিষেবা স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওয়াইসির সমালোচনা ও রাজনৈতিক বিতর্ক
অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (এআইএমআইএম)-এর প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি চলমান ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বিতর্ক নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র কড়া সমালোচনা করেছেন। হায়দ্রাবাদের এই সাংসদ বলেন, ভারতে যেখানে সহজে বলা যায় “আই লাভ মোদী”, সেখানে “আই লাভ মুহাম্মদ” বলা কঠিন হয়ে উঠেছে।
ওয়াইসি বলেন, “এই দেশে কেউ ‘আই লাভ মোদী’ বলতে পারে, কিন্তু ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ নয়। আপনারা এই দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কেউ ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বললে আপত্তি জানানো হচ্ছে। আমি একজন মুসলিম, তা মোহাম্মদের জন্যই। দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ১৭ কোটি ভারতীয়র জন্য এর উপরে আর কিছু নেই।” তিনি আইন ও শৃঙ্খলা নিয়ে সরকারের ভূমিকায় প্রশ্ন তুলে জনগণকে ধৈর্য ধরতে এবং আইনগত কাঠামোর মধ্যে কাজ করার আহ্বান জানান।
বরেলি বিভাগে উচ্চ সতর্কতা ও নিরাপত্তা জোরদার
উত্তরপ্রদেশের বরেলি বিভাগের বরেলি, শাহজাহানপুর, পিলিভিট এবং বুদাউন জেলায় উচ্চ সতর্কতা জারি করেছেন বিভাগীয় কমিশনার ভূপেন্দ্র এস চৌধুরী। দশেরা উৎসবের প্রস্তুতি হিসাবে এই চার জেলায় পুলিশ, প্রাদেশিক সশস্ত্র কনস্ট্যাবুলারি (পিএসি) এবং র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (আরএএফ) মোতায়েন করা হয়েছে। রামলীলা মাঠ, দুর্গাপূজা মেলা এবং রাবণ দহন কর্মসূচিতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
রাজনৈতিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িক উদ্বেগের কারণ
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন যে, এই ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বার্তার মধ্যে কোনো ভক্তিপূর্ণ গণসমাবেশ দেখা যায়নি। অনেকে এই বার্তাকে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি জনগণের সমর্থনের সঙ্গে তুলনা করলেও, এটি একটি বিশেষ ধর্মের রাজনৈতিকীকরণকে তুলে ধরছে। একইসঙ্গে এই ধরনের বার্তা একটি সাম্প্রদায়িক আন্দোলনের রূপ নিতে পারে, যা ভবিষ্যতে ভারতে দাঙ্গা এবং অরাজকতার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারে বলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।