MiG21 decomissioned

ব্যুরো নিউজ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : প্রায় ছয় দশক ধরে ভারতের আকাশসীমার ঢাল হিসাবে কাজ করার পর, ঐতিহ্যবাহী মিগ-২১ যুদ্ধবিমানটি শুক্রবার চণ্ডীগড়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী (IAF) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিল। এই বিদায় অনুষ্ঠান ভারতীয় সামরিক বিমানচালনা ক্ষেত্রে এক যুগের সমাপ্তি চিহ্নিত করল।

ভব্য সমারোহে বিদায়

মিগ-২১-এর এই বিদায় উপলক্ষে ভারতীয় বিমান বাহিনী একটি জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, যার মহড়া বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সম্পন্ন হয়েছিল। মহড়ায় মিগ-২১ যুদ্ধবিমানগুলি জাগুয়ার এবং সূর্য কিরণ অ্যারোব্যাটিক দলের সাথে ফর্মেশন ফ্লাই করে। এছাড়া, আকাশ গঙ্গা স্কাইডাইভাররা প্রায় ৪,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে লাফিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে।

অবসরের এই আবেগঘন মুহূর্তে বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল এপি সিং নিজেই মিগ-২১ এর ককপিটে বসেন। ঐতিহাসিক এই শেষ উড়ানটির নেতৃত্ব দেন স্কোয়াড্রন লিডার প্রিয়া শর্মা। বিদায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান, তিন বাহিনীর প্রধান, ছয় জন প্রাক্তন আইএএফ প্রধান এবং আইএএফ-এর সমস্ত কমান্ডের কমান্ডার-ইন-চিফগণ।

Operation Sindoor : পারমাণবিক হুমকিকে ভয় পায় না ‘নতুন ভারত’: সন্ত্রাসীর স্বীকারোক্তির পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর বার্তা।

গৌরবময় যুদ্ধের মুহূর্তের পুনঃসৃষ্টি

১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধের গৌরবময় মুহূর্তগুলি বিশেষ ভাবে পুনঃসৃষ্টি করে মিগ-২১-এর কিংবদন্তী যুদ্ধকালীন অবদানকে তুলে ধরা হয়। আইএএফ-এর ২৩তম স্কোয়াড্রন, যা “প্যান্থার্স” নামে পরিচিত, বিজয়ী ফর্মেশনে উড়ে যায়। এরপর মিগ-২১-এর একটি “ক্লাউড” ফর্মেশন ভারতের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি তেজস যুদ্ধবিমানের সাথে একত্রে উড্ডয়ন করে। এই প্রতীকী প্রদর্শন মিগ-২১ থেকে আধুনিক তেজসের কাছে দেশের আকাশ-আধিপত্যের ভার হস্তান্তরের ইঙ্গিত দেয়।

জল কামানের স্যালুট ও স্কোয়াড্রন বাতিল

বিদায়ের চূড়ান্ত আবেগঘন মুহূর্তে, ছ’টি মিগ-২১ একসঙ্গে মূল মঞ্চের সামনে অবতরণ করে এবং সেগুলিকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আইএএফ-এর ঐতিহ্য অনুসারে, অবসর গ্রহণের আগে বিমানগুলিকে ‘জল কামানের স্যালুট’ (water cannon salute) দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মিগ-২১-এর উভয় অপারেশনাল স্কোয়াড্রন – ‘কোবরা’ এবং ‘প্যান্থার্স’ – অবসরপ্রাপ্ত (decommissioned) করা হয়।

মিগ-২১-এর গৌরবময় উত্তরাধিকার

সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক ১৯৫০-এর দশকে ডিজাইন করা মিগ-২১ বিমানটি ১৯৬৩ সালে আইএএফ-এ যুক্ত হয় এবং এটি ভারতের প্রথম সুপারসনিক ফাইটার ছিল। ভারত মোট ৮৭৪টি বিমান সংগ্রহ করেছিল, যার চূড়ান্ত আপগ্রেডেড সংস্করণ “বাইসন” ২০১৩ সালে পরিষেবাতে আসে। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধ থেকে শুরু করে কার্গিল সংঘাত পর্যন্ত, মিগ-২১ ভারতের বিমান বিজয়ের কেন্দ্রে ছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে, এটি ঢাকা গভর্নর হাউসে বোমাবর্ষণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বের মনোবল ভেঙে দেয় এবং তাদের আত্মসমর্পণের দিকে ঠেলে দেয়। এমনকি ২০১৯ সালে, বালাকোট সংঘাতের সময় একটি মিগ-২১ বাইসন পাকিস্তানের উন্নত এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে ভূপতিত করে আধুনিক আকাশযুদ্ধেও তার প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করেছিল।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে মিগ-২১ অসংখ্য বীরত্বের সাক্ষী। এর অবদান একটি একক ঘটনা বা একটি একক যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।” তিনি বলেন, এই যুদ্ধবিমানটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, কার্গিল যুদ্ধ, বালাকোট বিমান হামলা, এবং এমনকি অপারেশন সিন্দুরেও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তিনি যোগ করেন, মিগ-২১ শুধু একটি যুদ্ধবিমান নয়, বরং জাতির স্মৃতি ও আবেগের সাথে গভীরভাবে জড়িত একটি “পরিবারের সদস্য”, যা দেশের আত্মবিশ্বাসকে আকার দিয়েছে।

Operation Sindoor : ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ভাঙল লস্করের মেরুদণ্ড ,সংসদ ও মুম্বাই হামলার মূল অর্থযোগানদাতা আব্দুল আজিজ নিহত

বিভ্রান্তি নিরসন ও আপগ্রেডেশন

মিগ-২১-এর বয়স নিয়ে ওঠা সমালোচনার জবাবে রাজনাথ সিং স্পষ্ট করেন যে, আইএএফ ৬০ বছরের পুরোনো বিমান ওড়াচ্ছে না। তিনি জানান, বর্তমানে যে মিগ-২১ বিমানগুলি ব্যবহার হচ্ছিল, সেগুলি সর্বোচ্চ ৪০ বছরের পুরোনো ছিল, যা এই ধরনের বিমানের জন্য স্বাভাবিক। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, ‘ত্রিশূল’, ‘বিক্রম’, ‘বাদল’ এবং ‘বাইসন’-এর মতো নামে পরিচিত এই বিমানটি তার পরিষেবা জীবনে ক্রমাগত প্রযুক্তিগতভাবে আপডেট এবং আধুনিকীকরণ করা হয়েছিল। তিনি হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (HAL)-এর ভূমিকারও প্রশংসা করেন, যারা উন্নত রাডার এবং অ্যাভিওনিক্স দিয়ে মিগ-২১-এর আপগ্রেডেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

অবসরের কারণ ও বিতর্ক

অবসরের অন্যতম প্রধান কারণ হলো মিগ-২১-এর নিম্ন নিরাপত্তা রেকর্ড। জানা যায়, এটির অন্তর্ভুক্তির পর থেকে ৪০০টিরও বেশি মিগ-২১ বিধ্বস্ত হয়েছে। পুরোনো প্রযুক্তি, ইঞ্জিন ত্রুটি এবং দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণকে এর দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। এই দুর্ঘটনাপ্রবণতার কারণে বিমানটি “ফ্লাইং কফিন” এবং “বিধবা সৃষ্টিকারী” (widow maker) নামেও পরিচিত ছিল। মিগ-২১-এর বিদায় আইএএফ-এর একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটালো, এবং তেজসের মতো আধুনিক দেশীয় বিমানগুলিকে তার স্থান নেওয়ার পথ খুলে দিল।

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর