ব্যুরো নিউজ ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : নেপালে সপ্তাহব্যাপী চলা তীব্র বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি অবশেষে পদত্যাগ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত এবং সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই গণবিক্ষোভ দ্রুত রাজনৈতিক সংকটে রূপ নেয়। প্রধানমন্ত্রীর এই পদত্যাগের খবরটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন তাঁর সরকারের দুজন মন্ত্রী—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক এবং কৃষিমন্ত্রী রামনাথ অধিকারী—ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। একই সাথে, নেপালের যোগাযোগ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুং ঘোষণা করেছেন যে, সরকার পূর্বে ঘোষিত সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তিনি জানান, মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দ্রুত ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইনস্টাগ্রামসহ অন্যান্য সাইটগুলো পুনরায় চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিক্ষোভের কারণ ও সহিংসতা
গত কয়েকদিন ধরে নেপালের তরুণ প্রজন্ম, যারা ‘জেন-জি’ নামে পরিচিত, দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তাদের প্রধান দাবি ছিল সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। এই প্ল্যাটফর্মগুলো নেপালি কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত হতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সরকার ২৬টি সাইট নিষিদ্ধ করেছিল। বিক্ষোভকারীরা এই নিষেধাজ্ঞাকে বাক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখেছিল।
বিক্ষোভ দ্রুত সহিংসতায় পরিণত হয় যখন প্রতিবাদকারীরা পার্লামেন্ট প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ জলকামান, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করে। এক পর্যায়ে পুলিশ সরাসরি গুলি চালায়, যার ফলে কাঠমান্ডু ও পূর্ব নেপালের সুনসারি জেলায় কমপক্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং ৩০০-রও বেশি মানুষ আহত হন।
Nepal : নেপালে সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভে ১৯ জনের মৃত্যু
প্রধানমন্ত্রী অলি শুরুতে এই সহিংসতার জন্য “কিছু অবাঞ্ছিত উপাদানের অনুপ্রবেশকে” দায়ী করেন। তিনি বলেছিলেন যে সরকারের উদ্দেশ্য সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করা নয়, বরং সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। তবে বিক্ষোভকারীদের দমন করতে সরকারের কঠোর প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক চাপ বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের পদত্যাগ ঘটে। এরপর কৃষিমন্ত্রী রামনাথ অধিকারীও সরকারের “স্বৈরাচারী” প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিক্ষোভের দ্বিতীয় দিনেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। বিক্ষোভকারীরা কাঠমান্ডুতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, শাসক দলের কার্যালয় এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। এর ফলে কাঠমান্ডুসহ দেশের বিভিন্ন শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার নেপালে থাকা তাদের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তারা নেপালের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে। তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিস্থিতি সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই বিক্ষোভকে ‘আরব বসন্ত’ বা ইউক্রেনের ‘কমলা বিপ্লবের’ মতো শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক চীন সফরের পর অলি সরকার যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করেছিল, তা জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে। যদিও গত কয়েক মাস আগে নেপালে রাজতন্ত্রের পক্ষেও বিক্ষোভ হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিক্ষোভটি ব্যাপক জনসমর্থন পেয়ে দেশজুড়ে সহিংসতায় রূপ নেয়। এটি আবারও প্রমাণ করে যে জনগণের মৌলিক অধিকারের উপর আঘাত এলে তার ফল কী হতে পারে। ২০০৬ সালে নেপালে যে বামপন্থী এবং মাওবাদী বিদ্রোহ রাজ তন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল এবং পৃথিবীর এক মাত্র হিন্দু রাষ্ট্র তাঁর বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল – সেই ঘটনার উলটপুরাণ হিসেবে এই আন্দোলনকে দেখা হচ্ছে !