ব্যুরো নিউজ ৩০ জুন: বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তার তৃতীয় বছরে পদার্পণ করেছে, এবং সম্প্রতি ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার এক বিশাল বিমান হামলা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। ইউক্রেন এটিকে ২০২২ সালে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে “সবচেয়ে ব্যাপক” হামলা হিসেবে বর্ণনা করেছে।
সবচেয়ে ব্যাপক বিমান হামলা ও ইউক্রেনীয় পাইলটের মৃত্যু
রবিবার (২৯ জুন, ২০২৫) ভোরে রাশিয়া ইউক্রেনের কেন্দ্রীয়, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল লক্ষ্য করে সমন্বিত হামলা চালায়। ইউক্রেনের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া ৪৭৭টি ড্রোন ও ডিকয় (ডামি লক্ষ্যবস্তু) এবং ৬০টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী এর মধ্যে ২৪৯টি ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়, যখন ২২৬টি সম্ভবত ইলেকট্রনিক জ্যামিংয়ের মাধ্যমে অকার্যকর করা হয়। লভিভ, মাইকোলাইভ, পোলতাভা, দনিপ্রোপেত্রোভস্ক, চেরকাসি এবং অন্যান্য অঞ্চলে হামলার খবর পাওয়া গেছে।
এই ব্যাপক হামলার সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল ম্যাকসিম উস্টিমেনকো (৩১) নামের একজন ইউক্রেনীয় যুদ্ধবিমান চালক একটি এফ-১৬ জেট উড়ানোর সময় নিহত হন। বিমান বাহিনী জানিয়েছে, তিনি একাধিক হুমকি প্রতিহত করার জন্য বিমানে থাকা সমস্ত অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। একটি সামরিক পোস্টে বলা হয়েছে, “শেষ লক্ষ্যবস্তুটিকে গুলি করে নামানোর সময় তার বিমানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উচ্চতা হারাতে শুরু করে।” তিনি সময়মতো বিমান থেকে বের হতে পারেননি বলে জানা গেছে, এবং তার মৃত্যু এই যুদ্ধে তৃতীয় এফ-১৬ জেটের ক্ষতি চিহ্নিত করে। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা তার এই কাজকে অসাধারণ সাহস ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
রুশ বিমান হামলা স্থলভিত্তিক এবং আকাশ থেকে পরিচালিত যুদ্ধবিমান উভয় থেকেই চালানো হয়েছিল – তাই এফ-১৬ বিমানটির ভূপাতিত হওয়ার ঘটনাকে রুশ বিমান বাহিনীর মিগ-২৯ বা সুখই-৩৫ ব্যবহার করে গুলি করে নামানোর (এয়ার-টু-এয়ার কিল) সম্ভাবনা প্রবল ।
অপারেশন সিঁদুরে ৮ F-16, ৪ JF-17 ভূপাতিত; বিপুল ক্ষতি পাক বিমান বাহিনীর
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক বিপর্যয়
এই হামলায় বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বেসামরিক নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। খেরসন অঞ্চলে একটি আবাসিক এলাকায় ড্রোন হামলায় একজন নিহত হয়েছেন, এবং খারকিভ অঞ্চলে একটি গাড়িতে ড্রোন আঘাত হানলে আরও একজন মারা যান। চেরকাসিতে একজন শিশুসহ ছয়জন আহত হয়েছেন। লভিভের দ্রোহোবিচ শহরের একটি শিল্প স্থাপনায় ড্রোন হামলায় বড় ধরনের আগুন লেগে যায় এবং শহরের কিছু অংশে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনী এই হামলাকে দূরপাল্লার ড্রোন, ডিকয় ইউনিট এবং নির্ভুল-গাইডেন্স মিসাইল সহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করে চালানো হামলা বলে বর্ণনা করেছে।
পশ্চিমাদের কাছে ইউক্রেনের আহ্বান
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের কাছে উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য নতুন করে আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন আমেরিকান সিস্টেম কিনতে প্রস্তুত, যদি প্রয়োজন হয়। জেলেনস্কি তার সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ম্যাকসিম উস্টিমেনকো সাতটি লক্ষ্যবস্তু গুলি করে নামানোর সময় মারা গেছেন। তিনি জানান, রাশিয়া গত সপ্তাহেই ১,২৭০টিরও বেশি ড্রোন, ১১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১,১০০টির কাছাকাছি গ্লাইড বোমা নিক্ষেপ করেছে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “যতদিন মস্কোর ব্যাপক হামলা চালানোর সক্ষমতা থাকবে, ততদিন তারা থামবে না।”
ন্যাটো ও রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
এই ব্যাপক হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী ন্যাটো দেশগুলো, যার মধ্যে পোল্যান্ডও রয়েছে, তাদের আকাশসীমা পর্যবেক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য যুদ্ধবিমান উড়িয়েছে। যদিও কোনো অনুপ্রবেশের খবর পাওয়া যায়নি, তবে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের পথ ন্যাটো আকাশসীমার কাছাকাছি হওয়ায় আঞ্চলিক উত্তেজনা আবারও বেড়েছে। এদিকে, রাশিয়া দাবি করেছে যে, তারা তাদের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে আসা ইউক্রেনীয় ড্রোনগুলিকে গুলি করে নামিয়েছে এবং ব্রায়ানস্ক শহরে আঘাত হানার ফলে আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে। রাশিয়া দোনেৎস্ক অঞ্চলের নভোউক্রাইঙ্কা গ্রামের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে, যা ১,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্রন্টলাইন বরাবর তাদের ধীর কিন্তু ধারাবাহিক অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়।
যুদ্ধ পরিস্থিতি ও অচলাবস্থা
ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এই ধরনের হামলার ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা বেড়েছে, যখন শান্তি আলোচনা স্থবির হয়ে আছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি ইস্তাম্বুলে আলোচনা পুনরায় শুরু করার আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করলেও, যুদ্ধবিরতির অভাব এবং উভয় পক্ষের নতুন ক্ষয়ক্ষতির কারণে কোনো সমাধান এখনো অনেক দূরে বলে মনে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এই রুশ-ইউক্রেনীয় সংঘাত শুরু হয়েছিল রুশভাষী নাগরিকদের প্রান্তিককরণ বা জেলেনস্কির কিয়েভ সরকারের সমর্থিত আজভ নাৎসি গোষ্ঠীগুলির দ্বারা গণহত্যার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে। রাশিয়ান বাহিনী কিয়েভকে ঘিরে ফেলার পর তুরস্কের শান্তি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ প্রায় শেষ হতে চলেছিল। তবে রাশিয়ানরা কিয়েভ থেকে সরে আসার পর দনবাস অঞ্চল এবং ক্রিমিয়ায় উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং তখন থেকেই দুই বাহিনীর মধ্যে অবিরাম যুদ্ধ চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অস্ত্র ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করে আসছে, যেখানে রাশিয়া চীন, ইরান, বেলারুশ এবং উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধের জন্য সমর্থন পাচ্ছে। ইউক্রেন তার প্রায় ৩০% অঞ্চল হারিয়েছে এবং বিশাল এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়েছে। এত কিছুর পরও, একটি আলোচনার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন প্রশাসন ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সামরিক সহায়তা অনুমোদন করেনি। কিয়েভ আশা করছে যে ইউরোপীয় মিত্রদের জরুরি প্রয়োজন এবং ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা প্যাট্রিয়ট বা নাসামসের মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সরবরাহকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যা উচ্চ-গতির ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম।