ব্যুরো নিউজ ২৪ জুন : পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি ইরানের পক্ষ থেকে কাতারের আল উদেদ বিমান ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে ছয়টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে, যা এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির উপর একটি বড় আঘাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানীয় পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জবাবে এই আক্রমণ চালানো হয়েছে। সোমবার রাতে কাতারের উপর একাধিক বিস্ফোরণ দেখা গেলেও, কাতার সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির খবর নিশ্চিত করা হয়নি।
ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও ইরানের ভিডিও প্রকাশ
ইরান তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে কাতারের আল উদেদ বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছে দেখা গেছে। তরল জ্বালানি চালিত এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনার এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত চিহ্নিত করে। এই ভিডিওটিকে শক্তি প্রদর্শন এবং আঞ্চলিক উত্তেজনার মধ্যে নিজেদের উদ্দেশ্য জানানোর বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসরায়েলের অভিযানে গাজায় মানবিক সংকট: গ্রেটা থুনবার্গের ত্রাণবাহী তরী আটক, যুদ্ধ অব্যাহত
কাতারের প্রতিরক্ষা ও হতাহত না হওয়ার খবর
কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে যে, ইরান কর্তৃক আল উদেদ বিমান ঘাঁটির দিকে নিক্ষেপ করা ছয়টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রই সফলভাবে প্রতিহত করা হয়েছে। এর ফলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এই ঘাঁটিটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক অভিযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে এটি একটি প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। কাতারি কর্তৃপক্ষ পুনরায় নিশ্চিত করেছে যে, কোনো আঘাতের খবর নেই, যা উচ্চ-ঝুঁকির এই ঘটনার সময় তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা তুলে ধরে। কাতার তার আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে কাতারে থাকা তাদের নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাহরাইনে সতর্কতা ও আঞ্চলিক প্রভাব
ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বেড়েছে। বাহরাইনে সাইরেন বাজার খবর পাওয়া গেছে এবং বাসিন্দারা সম্ভাব্য পরিণতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ সতর্ক থাকতে বলেছে, কারণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল। বাহরাইনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একটি জননিরাপত্তা পরামর্শ জারি করে নাগরিক ও বাসিন্দাদের সড়ক ভ্রমণ সীমিত করতে এবং ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনার মধ্যে সতর্ক থাকতে বলেছে।
ইরানের ইঙ্গিত: পরিকল্পিত জবাব, উন্মুক্ত সংঘাত নয়
সম্ভাব্য উত্তেজনা প্রশমনের ইঙ্গিত হিসেবে ইরান জানিয়েছে যে, কাতারে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানীয় পারমাণবিক কেন্দ্রে ব্যবহৃত বোমার সংখ্যার সঙ্গে মিলে গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে এটি একটি সুপরিকল্পিত জবাব, উন্মুক্ত সংঘাত নয়। তবে ইরাকেও হামলার খবর পাওয়া গেছে, যা সংঘাতের সম্ভাব্য বিস্তৃত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
ইসরায়েলের হামলা ও পারমাণবিক উত্তেজনা
এই ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটছে যখন ইসরায়েল ইরানের ভূখণ্ডের গভীরে তার সামরিক অভিযান প্রসারিত করেছে। সোমবার ইসরায়েলি বাহিনী তেহরানের উচ্চ-প্রোফাইল স্থান, যার মধ্যে কুখ্যাত এভিন কারাগার এবং ইরানের বিপ্লবী গার্ডের সদর দফতর, লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এই হামলাগুলো তেহরানের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ইসরায়েলের কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যদিও ইসরায়েল শাসন পরিবর্তনের চেষ্টা করছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনটি ইরানীয় পারমাণবিক স্থাপনায়, যার মধ্যে সুরক্ষিত ফোর্ডো সাইটও অন্তর্ভুক্ত, নির্ভুল হামলা চালানোর পর উত্তেজনা আকাশচুম্বী হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন এই হামলাকে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রোধ করার জন্য একটি সীমিত অভিযান হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, ইরানীয় কর্মকর্তারা একে সার্বভৌমত্বের নির্বিচারে লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। এরপর থেকে ইরান এই অঞ্চলে আমেরিকান স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
কাতারের কঠোর প্রতিক্রিয়া ও যুদ্ধবিরতির ধোঁয়াশা
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি জানিয়েছেন যে, কাতার ইরানের এই হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্ব, আকাশসীমা, আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের সনদের চরম লঙ্ঘন বলে মনে করে। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাতার এই আগ্রাসনের প্রকৃতি ও মাত্রার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সরাসরি জবাব দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে। আনসারি সকল সামরিক পদক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করার এবং আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, কাতারই প্রথম দেশগুলির মধ্যে একটি যারা এই অঞ্চলে ইসরায়েলি উত্তেজনা বৃদ্ধির বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। তিনি আরও নিশ্চিত করেছেন যে, মার্কিন ঘাঁটিটি আগে থেকেই খালি করা হয়েছিল এবং হামলায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার সন্ধ্যায় ঘোষণা করেছেন যে ইসরায়েল এবং ইরান একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে পৌঁছেছে এবং একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করবে। তিনি এটিকে “১২ দিনের যুদ্ধের” সমাপ্তি বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের এই ঘোষণার পরেও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া নিয়ে ধোঁয়াশা ও সংশয় তৈরি হয়েছে। একজন সিনিয়র ইরানীয় কর্মকর্তা সিএনএন-কে জানিয়েছেন যে, তেহরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পায়নি এবং ইসরায়েল বা ওয়াশিংটনের সাথে শত্রুতা বন্ধ করার কোনো কারণ দেখছে না। তারা মার্কিন ও ইসরায়েলি নেতাদের মন্তব্যকে “প্রতারণা” হিসেবে দেখছে, যা ইরানের উপর আরও হামলার ন্যায্যতা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। ইরানীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচিও জানিয়েছেন যে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে কোনো যুদ্ধবিরতি “চুক্তি” হয়নি। হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগনও কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করেনি, এবং এটি এখনো অস্পষ্ট যে কথিত চুক্তিটি কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে জানানো হয়েছিল কিনা, অথবা উভয় পক্ষই শর্তাবলী মেনে চলতে ইচ্ছুক কিনা।
ভবিষ্যৎ সংঘাতের জটিলতা
পশ্চিম এশিয়ার এই সংঘাতের বর্তমান জটিলতা অত্যন্ত বিচিত্র। ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির ক্ষতি সম্ভবত যুদ্ধের উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। তবে, ইসরায়েল ইরানে শাসন পরিবর্তনের আশা করেছিল, যা এখনো অধরা রয়ে গেছে। অন্যদিকে, ইরান পশ্চিম এশিয়ার হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়া বৈশ্বিক বাণিজ্য পথ বন্ধ করে দিতে চায়। এটি প্রত্যাশিত যে, সরাসরি সংঘাত হয়তো কিছুটা কমতে পারে, তবে অঞ্চলে জড়িত দেশগুলি এবং আগ্রহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে প্রক্সি সংঘাত অব্যাহত থাকতে পারে। ইরান একটি বৃহৎ দেশ এবং ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক তৈরিতে দক্ষ, তাই তারা হয়তো তাদের নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে এবং একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবাক করে দিতে পারে।