Fordow Haifa US Iran Israel conflict

ব্যুরো নিউজ ২৩ জুন : মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে যখন রবিবার ভোররাতে ইসরায়েলের যুদ্ধে যোগ দিয়ে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনা, যার মধ্যে অত্যন্ত সুরক্ষিত ফোর্দো (Fordow) রয়েছে, বোমা হামলা চালিয়েছে। এই হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই ইরান ইসরায়েলের উপর পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে, যার মধ্যে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ‘খোরামশহর-৪’ (Khorramshahr-4) ব্যবহার করা হয়েছে।

মার্কিন হামলা: ট্রাম্পের ‘অত্যন্ত সফল’ অভিযান

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনা – ফোর্দো, নাতানজ এবং ইসফাহানে – “অত্যন্ত সফল” হামলার ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্প বলেন, “আমরা ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনা, যার মধ্যে ফোর্দো, নাতানজ এবং ইসফাহান রয়েছে, সেগুলোর উপর আমাদের অত্যন্ত সফল হামলা সম্পন্ন করেছি। সমস্ত বিমান এখন ইরানের আকাশসীমার বাইরে রয়েছে।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেনাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন যে প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু ফোর্দোতে “বোমার পূর্ণ পেলোড” নিক্ষেপ করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, “ফোর্দোতে বোমার পূর্ণ পেলোড নিক্ষেপ করা হয়েছে। সমস্ত বিমান নিরাপদে বাড়িতে ফিরছে। আমাদের মহান আমেরিকান যোদ্ধাদের অভিনন্দন। বিশ্বে এমন আর কোনো সামরিক বাহিনী নেই যারা এটা করতে পারত।” ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে “যদি দ্রুত শান্তি না আসে” তবে ইরানের উপর আরও হামলা চালানো হবে।
গত কয়েকদিন ধরে ট্রাম্প ইসরায়েলের সাথে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার কথা বিবেচনা করছিলেন। সপ্তাহের শুরুতে তিনি বলেছিলেন যে দুই সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধে প্রবেশের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

ইরান-ইসরায়েল মার্কিন যুদ্ধ: ট্রাম্পের কড়া হুঁশিয়ারি ও খামেনির যুদ্ধ ঘোষণা

হামলার কৌশল ও লক্ষ্যবস্তু: B-2 স্পিরিট বোমার ও GBU-57 এর গুরুত্ব

ইরানের ফোর্দো পরমাণু স্থাপনা, যা মার্কিন হামলার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, সেটি মাটির ৮০-৯০ মিটার গভীরে, পাহাড়ের পাথরের নিচে কংক্রিটের সাহায্যে নির্মিত। এটি কেবল বিশাল GBU-57 Massive Ordnance Penetrator (MOP) দ্বারা ভেদ করা সম্ভব, যা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই রয়েছে। মার্কিন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ছয়টি B-2 বোমারু বিমান ফোর্দো পরমাণু স্থাপনায় এক ডজনের বেশি ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের GBU-57 বাঙ্কার বাস্টার বোমা নিক্ষেপ করেছে।

B-2 স্পিরিট বোমার: B-2 স্পিরিট হল একটি দীর্ঘপাল্লার, স্বল্প-শনাক্তযোগ্যতা সম্পন্ন (stealth) বোমারু বিমান, যা অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ভেদ করতে সক্ষম। এর “stealth” বৈশিষ্ট্য একে শত্রুর সবচেয়ে sofisticated প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে অত্যন্ত সুরক্ষিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতা দেয়। GBU-57 MOP এর মতো বিশাল বোমা বহন করার ক্ষমতা B-2 কে অত্যন্ত সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য অদ্বিতীয় করে তুলেছে। ফোর্দোর মতো সুরক্ষিত স্থাপনায় আঘাত হানার জন্য B-2 বোমারু বিমান এবং GBU-57 MOP অপরিহার্য ছিল, কারণ অন্য কোনো প্রচলিত অস্ত্র এই গভীরতা ভেদ করতে পারত না।
মার্কিন নৌবাহিনীও এই হামলায় জড়িত ছিল, তাদের সাবমেরিনগুলো নাতানজ এবং ইসফাহান পরমাণু স্থাপনায় ৩০টি টোমাহক (TLAM) ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। একটি B-2 বোমারু বিমান নাতানজেও দুটি GBU-57 বোমা নিক্ষেপ করেছে।

ইরানের প্রতিক্রিয়া ও খোরামশহর-৪ ক্ষেপণাস্ত্রের গুরুত্ব

ট্রাম্প এই হামলাকে “অত্যন্ত সফল” বললেও, মার্কিন হামলার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ স্পষ্ট নয়। ইরানের গণমাধ্যম অনুসারে, মার্কিন হামলায় ফোর্দো সাইটের কেবল বাইরের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূগর্ভস্থ স্থাপনার দিকে যাওয়া তিনটি সুড়ঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচি বলেছেন যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র “জাতিসংঘের সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং এনপিটি লঙ্ঘন করে ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু স্থাপনায় গুরুতর অপরাধ করেছে।” তিনি বলেন, “আজ সকালের ঘটনাগুলো জঘন্য এবং এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি হবে। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যের এই অত্যন্ত বিপজ্জনক, বেআইনি এবং অপরাধমূলক আচরণে শঙ্কিত হওয়া উচিত। জাতিসংঘের সনদ এবং আত্মরক্ষার বৈধ প্রতিক্রিয়ার বিধান অনুসারে, ইরান তার সার্বভৌমত্ব, স্বার্থ এবং জনগণের সুরক্ষার জন্য সমস্ত বিকল্প সংরক্ষণ করে।”
মার্কিন হামলার কয়েক ঘণ্টা পরেই ইরান ইসরায়েলের উপর তার বৃহত্তম ক্ষেপণাস্ত্র ‘খোরামশহর-৪’ সহ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের দুটি দফায় হামলা চালিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি অনুসারে, ‘খোরামশহর-৪’ ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি শহরকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছে, যার মধ্যে হাইফা উল্লেখযোগ্য।

খোরামশহর-৪ (Khorramshahr-4) ক্ষেপণাস্ত্র: ‘খোরামশহর-৪’, যা ‘খাইবার’ নামেও পরিচিত, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেলোড বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্র। এটি ১,৫০০ কিলোগ্রাম ওয়ারহেড বহন করতে পারে এবং এর পাল্লা ২,০০০ কিলোমিটার। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এবং এটি একাধিক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। এর উচ্চ গতি এবং দূরপাল্লার ক্ষমতা ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। হাইফায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে, যদিও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে যে এই ক্ষতি সম্ভবত একটি ভুলভাবে চালিত ইন্টারসেপটরের কারণে হয়েছে।

পরবর্তী পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এদিকে, ইসরায়েলি বিমান বাহিনী জানিয়েছে যে তারা ইরানের Dezful বিমানবন্দরে দুটি ইরানি F-5 যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে এবং আটটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করেছে।
হামলার পর ইরানের পার্লামেন্টের বৈদেশিক নীতি কমিটির প্রধান আব্বাস গোলরু বলেছেন যে মার্কিন হামলার পর ইরান এখন তার ১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরমাণু অপ্রসারণ চুক্তি (NPT) থেকে বেরিয়ে আসার আইনি অধিকার রাখে। NPT-এর ১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একটি সদস্য দেশ “চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার অধিকার রাখে যদি সে মনে করে যে অসাধারণ ঘটনাগুলো তার দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থকে বিপন্ন করেছে।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মার্কিন হামলাকে “বিপজ্জনক উত্তেজনা” বলে নিন্দা করেছেন এবং সংঘাত নিরসনে কূটনীতির আহ্বান জানিয়েছেন। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম মার্কিন হামলার নিন্দা করে বলেছে যে ওয়াশিংটন অতীতের কৌশলগত ভুলগুলো পুনরাবৃত্তি করতে পারে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ রয়েছে, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আরও সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যাপক সংঘাত প্রতিরোধের জন্য সংযম ও কূটনীতির আহ্বান জানাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর