মিঠুন ৭ জুন : হাংরি আন্দোলন- বাংলা সাহিত্যের এক বিদ্রোহী অধ্যায়
হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত অধ্যায়। ১৯৬১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন চিরাচরিত বাংলা সাহিত্যের কাঠামো, ভাষা এবং বিষয়বস্তুকে চ্যালেঞ্জ করে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ‘হাংরি’ শব্দটি ইংরেজি ‘Hungry’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ক্ষুধার্ত’। এই আন্দোলনকে ‘হাংরি জেনারেশন’ বা ‘ক্ষুধার্ত প্রজন্ম’ আন্দোলনও বলা হয়।
প্রাচীন DNA-র মাধ্যমে পৃথিবীতে ফিরল Dire Wolf, ইতিহাসের নতুন অধ্যায়
পটভূমি ও সূচনা
১৯৫০-এর দশকে যুদ্ধ-পরবর্তী হতাশা, বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য এবং তথাকথিত ‘আদর্শ’ সাহিত্যের বিরুদ্ধে একদল তরুণ লেখক ও কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁদের কাছে বিদ্যমান সাহিত্য ছিল শৃঙ্খলিত, রক্ষণশীল এবং ভণ্ডামিতে ভরা। এই ক্ষোভ থেকেই ‘হাংরি আন্দোলন’-এর জন্ম।
এই আন্দোলনের প্রধান পুরুষ ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী, যিনি ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, ফাল্গুনী রায়, বিনয় মজুমদার সহ আরও অনেকে।
বৈশিষ্ট্য
হাংরি আন্দোলনের কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হলো:
⦁ বিদ্রোহ ও বিধ্বংসী মানসিকতা: প্রচলিত সাহিত্যিক ও সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক তীব্র বিদ্রোহ ছিল এই আন্দোলনের মূল সুর। তাঁরা সমাজের ভণ্ডামি ও প্রচলিত ধারণাকে আক্রমণ করতেন।
⦁ ভাষার ব্যবহার: হাংরি লেখকরা ভাষার প্রচলিত প্রয়োগ ভেঙে অশ্লীল শব্দ, গ্রাম্য ভাষা এবং আঞ্চলিক উপভাষা ব্যবহার করতেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ভাষার কৃত্রিমতা ভেঙে জীবনের বাস্তবতাকে প্রকাশ করা।
⦁ বিষয়বস্তুর স্বাতন্ত্র্য: যৌনতা, ক্ষুধা, মৃত্যু, হিংসা, বিকৃত রুচি, বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক অবক্ষয়, নৈরাশ্য – এমন সব উপেক্ষিত বিষয় তাঁদের লেখায় উঠে আসত।
⦁ মুক্ত ছন্দ ও কাঠামো: তাঁরা প্রচলিত ছন্দের বাঁধাধরা নিয়মকে অস্বীকার করেন এবং মুক্ত ছন্দ ও গদ্য কবিতার প্রচলন করেন।
⦁ প্রকাশের মাধ্যম: তাঁরা প্রধানত বুলেটিন, হ্যান্ডবিল এবং ছোট কাগজের মাধ্যমে তাঁদের লেখা প্রকাশ করতেন।
⦁ আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রভাব: এই আন্দোলন পাশ্চাত্য সাহিত্য, বিশেষ করে বিট জেনারেশন (Beat Generation) এবং সুররিয়ালিজম (Surrealism) দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
বিতর্ক ও মামলা
হাংরি আন্দোলনের লেখকরা তাঁদের লেখনীর কারণে তীব্র সমালোচিত হন এবং অনেক সময় আইনি জটিলতায় পড়েন। ১৯৬৪ সালে মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়, যা ছিল এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এই মামলায় মলয় রায়চৌধুরী দোষী সাব্যস্ত হলেও, পরে তিনি আপিলের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণিত হন।
ভ্যালেনটাইনস ডে-র নেপথ্যের করুণ ইতিহাস থেকে আজকের প্রেমের উৎসব। কিভাবে হল জানুন
প্রভাব
⦁ যদিও হাংরি আন্দোলনের আয়ুষ্কাল খুব দীর্ঘ ছিল না (মূলত ১৯৬১-৬৫ সাল), এটি বাংলা সাহিত্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল:
⦁
⦁ সাহিত্যে নতুন ভাষা ও বিষয়ের আগমন: এই আন্দোলন পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের প্রচলিত নিয়ম ভাঙতে উৎসাহিত করে।
⦁ সীমান্ত ভাঙার প্রবণতা: তথাকথিত ‘শ্লীল’ ও ‘অশ্লীল’-এর ধারণা ভেঙে দিয়ে তাঁরা সাহিত্যের পরিধি প্রসারিত করেন।
⦁ সাহিত্যে বিদ্রোহের ধারা: হাংরি আন্দোলন প্রমাণ করে যে সাহিত্য কেবল সৌন্দর্যচর্চা নয়, এটি প্রতিবাদ ও বিদ্রোহেরও এক শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে।
⦁ ছোট কাগজের গুরুত্ব বৃদ্ধি: বুলেটিন ও ছোট কাগজের মাধ্যমে প্রকাশনার ধারা জনপ্রিয়তা লাভ করে।
⦁ বিতর্ক ও আলোচনা: এই আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে নতুন বিতর্ক ও আলোচনার জন্ম দেয়।
⦁ হাংরি আন্দোলন একটি সীমিত সময়ের জন্য সক্রিয় থাকলেও, এর সাহসী এবং বিদ্রোহী মনোভাব বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটি প্রমাণ করে যে সাহিত্য সমাজের দর্পণ যেমন, তেমনি তা সমাজের অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধে এক সোচ্চার প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে।