ব্যুরো নিউজ ৩ জুন : পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC) তালিকা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্কের মধ্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। রাজ্য মন্ত্রিসভা সম্প্রতি একটি সংশোধিত OBC তালিকার খসড়া অনুমোদন করেছে, যা আগামী ৯ জুন থেকে শুরু হতে চলা রাজ্য বিধানসভার বাদল অধিবেশনে পেশ করা হবে। এই পদক্ষেপটি কলকাতা হাইকোর্টের পূর্ববর্তী রায় এবং ন্যাশনাল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস (NCBC)-এর ধারাবাহিক আপত্তির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
NCBC-র আপত্তির মূল কারণ
ন্যাশনাল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস (NCBC) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সুপারিশকৃত ৮৩টি জাতি, যার মধ্যে ৭৩টি মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত, কেন্দ্রীয় ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। NCBC সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা এক হলফনামায় উল্লেখ করেছে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই সম্প্রদায়গুলির পিছিয়ে থাকার বিষয়ে “যুক্তিযুক্ত এবং সমসাময়িক উপাদান” পেশ করতে পারেনি। কমিশন মনে করে, রাজ্যের সরকারি পরিষেবা খাতে এই সম্প্রদায়গুলির অপ্রতুল প্রতিনিধিত্ব প্রমাণ করার জন্য কোনো যৌক্তিকতা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেখানো হয়নি। NCBC আরও অভিযোগ করেছে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব পাঁচবার কমিশনে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং ৮৭টি জাতির সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক তথ্যের সর্বশেষ পরিসংখ্যান দিতে পারেননি।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
হাইকোর্টের রায় ও রাজ্য সরকারের প্রতিক্রিয়া
গত মে ২০২৪ সালে কলকাতা হাইকোর্ট ২০১০ সাল থেকে জারি করা প্রায় ১২ লক্ষ OBC সার্টিফিকেট বাতিল করে দেয়, যার একটি বড় অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ করে যে, “ধর্মই একমাত্র মাপকাঠি” হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, যা অসাংবিধানিক। এই রায়ের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। মার্চ ১৯, ২০২৫ তারিখে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার জানায় যে, তারা তিন মাসের মধ্যে নতুন OBC সমীক্ষা সম্পন্ন করবে। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতেই এই সংশোধিত তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।
মন্ত্রিসভার অনুমোদন ও নতুন তালিকা
২ জুন, ২০২৫ তারিখে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনগ্রসর কল্যাণ দফতরের পেশ করা সংশোধিত OBC তালিকার খসড়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমোদন দিয়েছেন। এই নতুন তালিকা অনুযায়ী, পূর্বের ৬৬টি জাতির মধ্যে ৬৪টিকে বহাল রাখা হয়েছে এবং নতুন করে ৭৬টি জাতিকে সংযোজিত করা হয়েছে। এর ফলে রাজ্যের OBC তালিকায় মোট ১৪০টি জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হবে। এই নীতিটি শীঘ্রই রাজ্য বিধানসভায় আলোচনার জন্য পেশ করা হবে। বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গে OBC সংরক্ষণের পরিমাণ ১৭%, যা দুটি ভাগে বিভক্ত – ওবিসি ‘এ’ (১০% কোটা, ৮১টি সম্প্রদায়, যার মধ্যে ৫৬টি মুসলিম) এবং ওবিসি ‘বি’ (৭% কোটা, ৯৯টি সম্প্রদায়, যার মধ্যে ৪১টি মুসলিম)।
পরিসংখ্যান ও বিতর্ক
- পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় ওবিসি তালিকায় মোট ৮৩টি জাতি অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে ৭৩টি মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত।
- বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ওবিসি তালিকায় মোট ১৭৯টি সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার মধ্যে ১১৮টি মুসলিম। নতুন তালিকা অনুযায়ী, মোট ১৪০টি সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত হবে।
- NCBC বারবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ওবিসি কোটা ১৭% থেকে ২২% করার সুপারিশ করেছে, কিন্তু রাজ্য এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কমিশন উল্লেখ করেছে যে, রাজ্যের মোট সংরক্ষণের কোটা বর্তমানে ৪৫% পর্যন্ত যায়, যা সুপ্রিম কোর্টের ৫০% সীমা ছুঁতে আরও ৫% মার্জিন রাখে। NCBC এই ৫% কোটা OBC-দের জন্য বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।
- জাতীয় প্যানেলটি আরও দাবি করেছে যে, রাজ্যের OBC কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের অনেক পিছিয়ে পড়া জাতি হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে। তাই তাদের দাবির সপক্ষে সঠিক প্রমাণ ও জাতিগত বিবরণ চেয়েছিল NCBC।
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
রাজ্য মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর, এই সংশোধিত OBC তালিকাটি এখন বিধানসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আগামী ৯ জুন থেকে শুরু হতে চলা বাদল অধিবেশনে এটি পেশ করা হবে। এই পদক্ষেপের পর কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে OBC তালিকা এবং সংরক্ষণের পরিমাণ নিয়ে আইনি ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন আরও তীব্র হতে পারে। বিশেষত, NCBC-র আপত্তি এবং সুপ্রিম কোর্টে চলমান মামলা এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব একতরফাভাবে OBC তালিকার এই পরিবর্তন কেন্দ্রের প্রস্তাবিত দেশব্যাপী জাতিভিত্তিক আদমশুমারিকে (Caste Census) বিরূপভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যথাযথ প্রতিবেদন এবং নথি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই পদক্ষেপটি জাতিগুলির মধ্যে বিভেদমূলক রাজনীতি তৈরির একটি অবৈধ প্রচেষ্টা, যা জাতীয় সংহতির জন্য সঙ্কট হয়ে উঠতে পারে।
