ব্যুরো নিউজ ১৫ই মে : হিন্দু দর্শনের ধর্ম নির্দেশক শ্রীমদ্ভগবত গীতা। এই মহান গ্রন্থে জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রকৃতির তিনটি মৌলিক উপাদান – ত্রিগুণ: সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ। এই তিনটি গুণ কিভাবে আমাদের জীবন এবং চেতনাকে প্রভাবিত করে, সেই বিষয়ে এক বিস্তারিত আলোচনা সম্প্রতি বিদ্বজ্জন মহলে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে।

গীতার ভাষ্য অনুযায়ী, এই ত্রিগুণ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এগুলি প্রতিটি জীব ও জড় পদার্থের মধ্যে বিদ্যমান। এই তিনটি গুণই আমাদের চিন্তা, কর্ম এবং স্বভাবকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।

সত্ত্বগুণ: এই গুণকে বিশুদ্ধতা, জ্ঞান এবং স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। সত্ত্বগুণ মানুষের মধ্যে নির্মলতা, আলোক এবং কল্যাণের অনুভূতি জাগায়। এর প্রভাবে মানুষ জ্ঞান অর্জন ও সুখের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ধার্মিকতা, প্রজ্ঞা, শান্তি এবং আনন্দ – এইগুলি সত্ত্বগুণের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যখন কোনও ব্যক্তির মধ্যে সত্ত্বগুণের প্রভাব বেশি থাকে, তখন তার আধ্যাত্মিকতার প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং সঠিক জ্ঞান অর্জনের পথে সে অগ্রসর হয়।

রজোগুণ: রজঃ গুণ কর্ম, আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষার পরিচায়ক। এটি অস্থিরতা ও কামনা-বাসনার জন্ম দেয়। এই গুণের প্রভাবে মানুষ ফল লাভের আশায় কর্মে লিপ্ত হয়। লোভ, তৃষ্ণা, নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন প্রকার কার্যকলাপ রজোগুণের বৈশিষ্ট্য। যখন রজোগুণ প্রবল হয়, তখন মানুষ জাগতিক উন্নতি ও স্বীকৃতির জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে এবং সেই লক্ষ্যে অবিরাম কাজ করে যায়।

তমোগুণ: তমঃ গুণ অজ্ঞানতা, জড়তা এবং অন্ধকারের স্বরূপ। এটি মোহ, আলস্য এবং ঔদাসীন্যের কারণ। তমোগুণ মানুষের বিচার-বিবেচনা লোপ করে এবং ভুল পথে চালিত করে। অলসতা, ঘুম, ঔদাসীন্য এবং অজ্ঞতা তমোগুণের প্রধান লক্ষণ। এই গুণের প্রভাবে মানুষ জ্ঞান ও কর্মের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং মোহ ও বিভ্রান্তির শিকার হয়।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন যে এই তিনটি গুণ প্রকৃতির থেকেই উৎপন্ন হয় এবং এগুলি জীবাত্মাকে দেহবদ্ধ করে রাখে। যদিও সত্ত্বগুণ তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ, তবুও সুখ ও জ্ঞানের প্রতি আসক্তির কারণে এটিও বন্ধনের কারণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের জীবনে এই তিনটি গুণের প্রভাব বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায়। কখনও সত্ত্বগুণ প্রবল হয়ে রজঃ ও তমঃকে পরাভূত করে, আবার কখনও রজোগুণ প্রবল হয়ে অন্য দুটি গুণকে দমিয়ে দেয়। একইভাবে, তমোগুণের প্রভাবে সত্ত্ব ও রজঃ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

গীতার তাৎপর্য অনুযায়ী, মৃত্যুর সময় যে গুণটি মানুষের মধ্যে প্রবল থাকে, সেটি তার পরবর্তী জন্ম নির্ধারণ করে। সত্ত্বগুণে মৃত্যু হলে জ্ঞানী ও পবিত্র লোকে জন্ম হয়, রজোগুণে মৃত্যু হলে কর্মাসক্তদের মধ্যে এবং তমোগুণে মৃত্যু হলে অজ্ঞানীদের মধ্যে জন্ম হয়।

তবে, ভগবত গীতা আমাদের এই ত্রিগুণের প্রভাবের ঊর্ধ্বে ওঠার এবং মোক্ষ লাভের পথের সন্ধান দেয়। নিষ্কাম কর্ম, ভক্তি এবং আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে এই গুণগুলির প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব এবং পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়।

এই ত্রিগুণ তত্ত্ব শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনেও এর তাৎপর্য অপরিসীম। এই তত্ত্ব অনুধাবন করে আমরা নিজেদের স্বভাব ও কর্মের প্রকৃতি বুঝতে পারি এবং উন্নত জীবন যাপনের জন্য সচেতন প্রচেষ্টা চালাতে পারি।

সাম্প্রতিক আলোচনা এই প্রাচীন তত্ত্বের গভীরতা এবং প্রাসঙ্গিকতাকে আরও একবার তুলে ধরেছে, যা বর্তমান সমাজেও জ্ঞান ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণের পথে এক মূল্যবান দিশা দেখাতে সক্ষম।

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর