দীপাঞ্জন গন, কেশপুরঃ যাচ্ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুরে। উপলক্ষ পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারসভা। যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়লেন, খড়্গপুর গ্রামীণের কংসাবতীর পাড়ের মাতকাতপুর গ্রামে। শুরু করলেন, রাজনীতির সেই চেনা জনসংযোগ কর্মসূচি। অর্থনীতির প্রান্তে থাকা দরিদ্র গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করলেন, রেশন আর স্বাস্থ্যসাথী তাঁরা পান কিনা। কিন্তু সেই চেনা প্রশ্নের মন-খুশি করা উত্তর না দিয়ে গ্রামবাসীরা জানালেন, তাঁরা খুব কষ্টে আছেন। ঘর পাচ্ছেন না। কারণ যেখানে তাঁরা বহুবছর ধরে রয়েছেন, পাট্টা এখনও পর্যন্ত প্রশাসনের কাছ থেকে পাননি। জমির মালিকানা নেই। তাই আবাস যোজনা থেকেও বঞ্চিত। শুনেই সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ফোন করলেন নৈহাটির বিধায়ক তথা রাজ্যের রাজ্যের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিককে। কারণ জমিটা যে সেচদফতরের অধীনে! এরপর যে সংলাপ কানে শোনা গেল, তা নিছকই রাজনীতির রেসিপি মেনে বলা, বাঁধাধরা কিছু কথাবার্তা। চুম্বকে এটাই হয়ে থাকল, শনিবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেশপুর সফরের ক্যাচলাইন।
একসময় যে কেশপুর বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল, গত ২০০৭ সালের পর থেকে সেটাই হয়ে উঠেছিল, বধ্যভূমি। বোমা বন্দুক আর গুলির আওয়াজ ছাড়া কোনও ভোর এখানে হত না। রাজ্যে শাসন ক্ষমতার পালা পরিবর্তনের পর, সেই কেশপুর এখন শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র চারণভূমি। তবে গত বেশ কয়েকবছর ধরেই, এলাকার ক্ষমতা দখলে রাখা এবং একাধিক আর্থিক কারণে শুরু হওয়া গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বের কাছে, মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় কোনও নেতাকে একক দায়িত্ব দিলে, বা আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে এলাকার নেতাদের বেছে দেওয়া প্রার্থীকে টিকিট দিলে, ভোটব্যাঙ্কে অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দিয়েছেন, শাসকদলের শীর্ষনেতৃত্বের একাধিক সূত্র। এই পরিস্থিতিতে সরাসরি কেশপুর হাতে রাখতে উদ্যোগী হলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের নাম্বার টু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর বহুদিন পর সেখানে দলীয় তথা রাজনৈতিক সফরে গিয়ে, সেটাই যেন বুঝিয়ে দিলেন শাসকদলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। দলীয়সভার মঞ্চ থেকে এদিন প্রায় অজ্ঞাত পরিচয় গ্রামবাসীকে, উপস্থিত ভিড়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে অভিষেক বললেন, এঁরাই হয়ে উঠবেন নতুন তৃণমূলের মুখ।
একইসঙ্গে এইদিন, কেশপুরে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটাতে একমাসের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এখানে আসার পথে মারিশদায় নেমে, স্থানীয় তাতলা ১ নম্বর গ্রামপঞ্চায়েতে ফের একবার সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়েছিলেন অভিষেক। আর তখনই রাজ্যের এই অত্যন্ত ক্ষমতাবান নেতাকে হাতের কাছে পেয়ে, সেখানকার গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধানসহ দুই পদাধিকারীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দেন, গ্রামবাসীরা। এরপর কেশপুরের সভা থেকে তাতলা ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই দুই পদাধিকারীকে ইস্তফা দিতে নির্দেশ দেন অভিষেক।
একদিকে জনসংযোগের নামে জনমোহিনী চমক। দলীয় পদাধিকারবলে স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচিত প্রধান অধিকারীদের ইস্তফার নির্দেশ। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়ে বিরোধীশিবিরের সমালোচনা শুরু হতেও এদিন খুব বেশি দেরি হয়নি। সংসদীয় রাজনীতির শর্ত মেনে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে, তাঁর দলের কোনও উচ্চপদাধিকারী কোনও দলীয় সভা থেকে এভাবে পদত্যাগের নির্দেশ দিতে পারেন কিনা, তা নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। অন্যদিকে যেভাবে নতুন তৃণমূলের মুখ তুলে ধরতে, নিরীহ এক গ্রামবাসীকে দলীয় সভার মঞ্চে তুলে, তাঁর মেয়ের বিয়ের ভার নিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তার সমালোচনা করেছে বামেরাও।