ইভিএম নিউজ ব্যুরো, ৪ ঠা মার্চঃ “আমরা ২৩৫, ওরা ৩০” …মনে আছে আপনাদের? নিশ্চয়ই মনে আছে। একদশকেরও অধিক হল বাম শাসনের অবসান হয়েছে। লাল জমানায় তৈরি হওয়া ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে মানুষ বেছে নিয়েছিল পরিবর্তনের পথ।রাজ্যের দায়িত্বভার তুলে দিয়েছিল মমতা পরিচালিত জোট সরকারের হাতে। কিন্তু তারপর? পশ্চিমবঙ্গে স্বৈরতন্ত্রের অবসান আদতে কি ঘটেছে?
সময়টা ছিল ২০১২-র এপ্রিল মাস। তৎকালীন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর নিজের ফেসবুক পোস্টে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুকুল রায়কে নিয়ে একটি কার্টুন প্রকাশ করেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। তারই ভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ নম্বর ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছিল পূর্ব যাদবপুর থানার পুলিশ। গ্রেফতার হতে হয়েছিল এই অধ্যাপককে।
দীর্ঘ ১১ বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পর, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যে ধারায় অম্বিকেশ মহাপাত্রর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল সেই ধারাটি অসাংবিধানিক ও ভিত্তিহীন বলে ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে ক্ষমতার অপব্যবহার করা পুলিশ মন্ত্রী মমতার নির্দেশেই হেনস্থা হতে হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপককে।
একই ঘটনা ঘটে বেলপাহাড়ির এক নিরপরাধ ব্যাক্তি শিলাদিত্য চৌধুরীর সঙ্গে। ২০১২ সালের ১২ই আগস্ট বেলপাহাড়িতে একটি সরকারি সভার মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাষণ চলাকালীনই মমতার সিকিউরিটি জোনের সামনে ঢুকে পরেন পেশায় কৃষক শিলাদিত্য। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন, কেন বাড়ছে সারের দাম?আর তাতেই জুটেছিল মাওবাদী তকমা। বেজায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ নিজের ভাষণ থামিয়ে সেখানে উপস্থিত পুলিশ কর্তাদের বলেন, ‘ওই ব্যক্তি এখানে কী করে ঢুকল? ও আসলে মাওবাদী৷ সিপিএম পাঠিয়েছে৷ ধরুন, ধরুন ওকে৷’ এরপরই পুলিশ কর্তাদের মধ্যে শুরু হয় তৎপরতা৷ শিলাদিত্যকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মঞ্চের ঠিক পিছনে৷ মুখ্যমন্ত্রী জনতাকে বলেন, ‘দেখলেন তো, কেমন হাতেনাতে মাওবাদী ধরে দিলাম?’ ওই ঘটনার পর শিলাদিত্যকে ১৪ দিন জেল পর্যন্ত খাটতে হয়৷ পরে আদালতের নির্দেশে জেল থেকে ছাড়া পেলেও দীর্ঘ ১২ বছর অতিক্রান্তের পরও মেলেনি ক্লিনচিট৷
এই প্রেক্ষাপটে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন তাঁদের নিজেদের মতন করে তদন্ত শুরু করে জানান যে এই ঘটনায় শিলাদিত্যের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে৷পাশাপাশি দু-লক্ষ টাকা জরিমানারও নির্দেশ দেওয়া হয় রাজ্য সরকারকে।কিন্তু রাজ্য সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই টাকা না দেওয়ায় শিলাদিত্য শেষ পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন৷আর তারপরই আদালতের তীব্র ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় রাজ্য সরকারকে।
২০২১ এর বিধানসভা ভোটের আগে মমতা যখন জেলা সফরে বেড়িয়েছিলেন সেই সময় তাঁকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন জায়গায় উঠেছিল জয় শ্রী রাম ধ্বনি। কনভয় থেকে নেমে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা গিয়েছিলো মুখ্যমন্ত্রীকে। আপত্তি তুলেছিলেন বিজেপির দলীয় স্লোগানে। এমনকি ভিক্টোরিয়ায় নেতাজির ১২৫ তম জন্ম দিবস অনুষ্ঠান কিংবা বন্দেভারত এক্সপ্রেসের উদ্ভোধন অনুষ্ঠানে ওঠা জয় শ্রী রাম ধ্বনিতেও আপত্তি তুলেছিল মমতা।
বিরোধীদের মতে স্বৈরাচারীতা আর বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মাত্রা ছাড়িয়েছে বিজেপি নেতা সজল ঘোষ, আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী এবং সর্বশেষ কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচীর গ্রেফতারীতে।
২০২১ এর বিধানসভা ভোটের পর লাগাতার অশান্তির অভিযোগ তুলে বনধের ডাক দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে অশান্তির খবর উঠে আসছিল সেই সময়। বনধের সমর্থনে বিজেপি নেতা সজল ঘোষের মিছিল বের হতেই শুরু হয় উত্তেজনা। মিছিল আটকাতে বৌবাজারে মোতায়েন হয়েছিলো প্রচুর পরিমাণ পুলিশ।শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা গ্রেফতার করা হয়েছিলো বিজেপি নেতা সজল ঘোষকে।
২০২৩ এর ২১ শে জানুয়ারি ভাঙড়ের হাতিশালায় দলীয় পতাকা লাগানোকে কেন্দ্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল ও আইএসএফ কর্মীরা। সেই গন্ডগোলের আঁচ এসে পড়েছিল কলকাতাতেও। গ্রেফতার করা হয়েছিলো আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী সহ বেশ কয়েকজনকে।দীর্ঘ ৪২ দিন জেলে বন্দী থাকার পর অবশেষে আদালতে জামিন পান তিনি।
সাগরদিঘি নির্বাচনের পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে ব্যাক্তিগত আক্রমণ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।তুলেছিলেন অধীরের মেয়ের আত্মহত্যার প্রসঙ্গ। তারই প্রত্যুত্তরে প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দীপক কুমার ঘোষের মমতার ব্যক্তি জীবনকে নিয়ে লেখা বইয়ের কথা প্রকাশ করে কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচী।
এরপরই শনিবার রাত ৩ টে নাগাদ তাঁর বাড়িতে হাজির হয় বটতলা থানার পুলিশের একটি টিম। সকাল ৮ টা নাগাদ গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।কৌস্তভের অভিযোগ একাধিক মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে তাঁকে। আর এতেই প্রতিবাদের সুর শোনা গিয়েছে বিভিন্ন মহলে।১২ ঘণ্টার মধ্যে কৌস্তভকে জামিনে মুক্তি দেয় আদালত।
হার্ভার্ডের একজন গবেষক স্বৈরাচারীতার পতন কীভাবে সম্ভব তা গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন, বিগত কয়েক দশকে বিশ্বের দেশে দেশে যেসব গণআন্দোলন-গণবিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে তাতে কোন জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩.৫ শতাংশ মানুষ যদি গণবিক্ষোভে অংশ নেয় তাতেই সফলতা পাওয়া সম্ভব। বিগত এক দশকে বাংলায় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার যে চিত্র ধরা পড়েছে সেখানে মানুষের প্রতিবাদ যদি গণ আন্দোলনের রুপ নেয় তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ।