আদ্যাপীঠ, তারাপীঠ, কালীঘাটের মন্দিরের ইতিহাস সকলেরই জানা। কিন্তু এইগুলি ছাড়াও আমাদের পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে আরও একটি জাগ্রত মায়ের মন্দির। যা অনেকেরই অজানা। আর এই মন্দিরের পিছনে রয়েছে অনেক অজানা তথ্য ও মুখে মুখে ফেরা অজানা কাহিনী। বীরভূম জেলার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ঐতিহাসিক গ্রাম ভদ্রপুর। এই গ্রামেরই পশিম প্রান্তে রয়েছে একটি ছোট্ট গ্রাম ‘অকালীপুর।’ অকালীপুরের দক্ষিণ প্রান্তে ব্রাহ্মণী নদীর তীরেই বাস ‘মা গুহ্য কালীর।’ ‘মা গুহ্য কালী’ প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল, অন্যান্য সতীপীঠের কালী শিবের ওপর দন্ডায়মান থাকে। কিন্তু এই প্রতিমা সর্পের ওপর বিরাজ করছেন।
লোকমুখে কথিত, আনুমানিক দুশো তিরিশ বা চল্লিশ বছর আগে মায়ের মূর্তির সন্ধান পান রানী ‘অহল্যাবাই’। রানী শিবলিঙ্গ খোঁজার জন্য খনন কার্য্য চালানোর সময় এই মূর্তি দেখতে পান। রানী অহল্যাবাই এই মূর্তি কাশীরাজ ‘চৈত সিং’ কে প্রদান করেন। কাশীরাজ চৈত সিং এই মূর্তির নিয়মিত পূজা অর্চনা শুরু করেন।
তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ গভর্ণর ‘ওয়ারেন হেস্টিং’ কাশী বাংলোতে থাকতেন। একদিন হঠাৎ করেই কাশীরাজের নব প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ কষ্টিপাথরের কারুকার্য সম্পন্ন মা’য়ের মূর্তি তিনি দেখেন এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরেন। সেইসময় ইংল্যাণ্ডের মিউজিয়ামে গুহ্য মায়ের বিগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন হেস্টিং। এরপর কাশীরাজ চৈত সিং হেস্টিংসের কুমতলবের কথা জানতে পারেন। চৈত সিং তখন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মায়ের বিগ্রহ রক্ষার স্বার্থে গঙ্গানদীর গর্ভে বিসর্জন করেন।
অন্যদিকে, মহারাজ নন্দকুমার কর্মসুত্রে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ান পদে নিযুক্ত ছিলেন। তবে তিনি একজন ধর্মপ্রান, উদার, মহানুভব মানব দরদী ব্রাহ্মন ছিলেন। তিনি গুহ্য মা’য়ের স্বপ্নাদেশে মাতৃ মূর্তি উদ্ধার করেন। ভদ্রপুরে মা’য়ের পুঃনপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কাশী যাত্রা শুরু করেন। খুরতুত ভাই ‘শম্ভুনাথ’কে সঙ্গে নিয়ে কাশীরাজ চৈত সিং এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। মা’য়ের স্বপ্নাদেশ ও কাশী আসার কারন বর্ণনা করেন নন্দকুমার। কাশীরাজ তখন হেস্টিং-এর আড়ালে গুহ্য মায়ের বিগ্রহ গঙ্গাবক্ষ থেকে উদ্ধার করে, নদী পথে বিগ্রহ সহ নন্দকুমার’কে ভদ্রপুরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন।
দীর্ঘ গঙ্গাপথ, দ্বারকা নদী অতিক্রম করে বাহ্মনী নদীতে এসে নৌকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নন্দকুমারের বাসভবন পার করে অকালীপুর এসে দাঁড়ায়। সেই মূহুর্তে মোনোনিত হয় মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে অকালীপুরের এই স্থানেই।
উলেক্ষ্য, ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই আগষ্ট মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসীর আদেশ দেয় তৎকালীন আদালত। ইংরেজ কতৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদের জেরেই এমন সাজা ঘোষণা করে আদালত। কিন্তু আগাধ ঈশ্বর বিশ্বাসী মৃতুপথযাত্রী নন্দকুমার তাঁর পুত্র ‘গুরুদাস’-কে নির্দেশ দেন অসমাপ্ত মা’য়ের মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকার্য্য সম্পূর্ণ করার। কথিত আছে মহারাজ নন্দকুমার রায়ে’র ফাঁসীর সময় মা’য়ের মন্দিরের চূড়া ফেটে যায়। আজও সেই চূড়া ফাটা অবস্থাতেই রয়েছে। মহারাজ নন্দকুমার রায়ে’র ঐতিহ্য বহন করেই আজও অকালীপুরের মন্দিরে ‘মা গুহ্য কালী’ অধিষ্ঠিত। তারাপীঠ মন্দির থেকে অতিশয় দূরে অবস্থিত এই মন্দির।