ইভিএম নিউজ ব্যুরোঃ এ যেন দু’পা এগিয়েও একপা পিছনোর মতো। যদিও রাজনীতিতে এটাই একটা স্বাভাবিক দস্তুর। গত কিছুদিন ধরেই বিশ্বভারতীর জমি বিতর্কে উত্তপ্ত কাজিয়া চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের মধ্যে। আর সেই বিতর্কে প্রথমে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও তারপর রাজ্যের পদ্মশিবিরের একাধিক শীর্ষনেতা টিকাটিপ্পানি করেছেন। পাল্টা অমর্ত্য সেনের বাড়িতে গিয়ে, তার হাতে জমিসংক্রান্ত সরকারি কাগজ তুলে দেওয়ার পর, সরকার তথা শাসকদল তো বটেই, সেই সঙ্গে খোদ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক তোপ দেগেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও বিতর্কিত এবং আইনি এই বিষয়টিতে গেরুয়া বনাম নীল-সাদা রঙে রাঙানোর এই ‘তৃণমূলী চেষ্টা’কে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন স্বয়ং উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। আর রাজ্যের সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণ মোকাবিলায় তিনি নিজেই যে যথেষ্ট, সেটাও আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। হয়তো সে কারণেই, রাজ্যে অমিত শাহের নির্বাচনী সফরের আগে, মূলত অমর্ত্য সেন বিতর্কে কিছুটা সুর নামালো, বঙ্গ বিজেপির নেতৃত্ব। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, নির্দিষ্ট আইনি বিষয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একজন ব্যক্তির সংঘাতে দলের জড়ানোর অর্থ, তৃণমূলের প্ররোচনায় পা দেওয়া, এটা বুঝেই আপাতত ‘বিশ্বভারতী বনাম অমর্ত্য’ সংঘাতে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতির রং থেকে মুক্ত রাখতে চাইছে, বঙ্গ বিজেপি। সেই একই চেষ্টার অভিযোগে অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যের শাসকদলকে চাপে ফেলা যায়।
রাজনৈতিক এই কৌশলের ইঙ্গিত পাওয়া গেল শনিবার।
ডায়মন্ড হারবারে একটি দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বিশ্বভারতী ও অমর্ত্য সেন বিষয়ে সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘জমি সংক্রান্ত মিউটেশনের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা সাধারণত ঘটে। তবে উনি শ্রদ্ধেয় মানুষ। ওঁর বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রাজ্য সরকার এবং ওঁর প্রতিনিধি মিলে দ্রুত সমাধান করা উচিত।’’ অন্যদিকে বিজেপি বিধায়ক অশোক লাহিড়িও বলেন, ‘‘আমি সৌজন্যের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। কাদা ছোড়াছুড়িতে না।’’ তিনি আরো বলেন, “‘‘সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে পরিবারের গন্ডগোল হলে সামলানো দরকার। জমি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, অনুসন্ধান হোক। এই নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি ঠিক না।’’
এই দুই নেতার মন্তব্য কিছুটা রাজ্য বিজেপির এক পা পিছিয়ে দুই পা এগিয়ে যাওয়ার কৌশল বলে মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। এর আগে শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষ থেকে তথাগত রায়েরা যেভাবে অমর্ত্য সেন ইস্যুতে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর অবস্থানকে সমর্থন করছিলেন, তাতে আরএসএস-বিজেপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে চর্চাস শুরু হয়েছিল একাধিক মহলে। পাশাপাশি অমর্ত্য সেনের ব্যাপারে আক্রমণকে বিজেপির ‘বাংলা বিরোধী’ অবস্থান বলেও চিহ্নিত করা হচ্ছিল গেরুয়া-বিরোধী শিবির থেকে। সূত্রের খবর, এই বিষয়টায় কিছুটা অস্বস্তিতেই পড়েছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সে কারণেই বিজেপির উচ্চতর নেতৃবর্গের নির্দেশেই অমর্ত্য সেন ও বিশ্বভারতী ইস্যুর সঙ্গে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে মিলিয়ে আক্রমনাত্মক অবস্থান থেকে সরে এসে এ নিয়ে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করার কৌশলই নেওয়া হচ্ছে বলে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
প্রসঙ্গত, অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ করে উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী এই বিষয়ে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদকে চিঠি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। এছাড়াও তিনি সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে একাধিকবার বিবৃতি দেন। এরপরেই বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদের পক্ষে মাঠে নামেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্বভারতী থেকেও মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করে বিবৃতি দেওয়া হয়। এরপরেই উপাচার্যকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেন শুভেন্দু অধিকারী ও দিলীপ ঘোষ। ট্যুইটারে অন্য একজনের ট্যুইট উল্লেখ তথাগত রায়ও আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন। এভাবেই অমর্ত্য সেন ইস্যুতে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তৃণমূল ও বিজেপি। কিন্তু রাজ্যের সুশীল ও বিদ্দজ্জন সমাজের কাছে এই ব্যাপারে একটা নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছিল, যার জেরে গোটা ঘটনায় বিজেপির উচ্চতর নেতৃত্ব সৌজন্যেই আস্থা রাখার পক্ষপাতী, আর সে কারণেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি ও দলীয় বিধায়ক এই ব্যাপারে কৌশলগতভাবে নরমপন্থী অবস্থান নিচ্ছেন বলেই ব্যাখ্যা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।