নরেন

প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়, ১০ জানুয়ারি: পরিব্রাজক নরেন

শিক্ষান্তে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ও সারদামনি দেবীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের পর ১৮৮৬ সালে যান হুগলির আঁটপুর গ্রামে। নরেনের এক গুরু ভাই ছিল বাবুরাম। তাঁর মা নরেন ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের আঁটপুর গ্রামে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা কোরতে গিয়ে বেশকিছু দিন ছিলেন আঁটপুরে। সে বছরই ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নরেন আরও ৮ জন আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। নরেনের নাম হয় ‘স্বামী বিবিদিষানন্দ’। ১৮৮৮ সালেই তিনি পরিব্রাজক হিসাবে বেড়িয়ে পড়েন একা। হাতে ছিল তাঁর একটি লাঠি, কমন্ডুলু। সঙ্গে ছিল দুটি প্রিয় গ্রন্থ, ভগবদগীতা ও ইশানুসরণ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তিনি ভ্রমণ করেন। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটে। সারা ভারতবর্ষ তিনি পায়ে হেটে ঘুরেছিলেন, ভিক্ষান্নের ওপর ভিত্তি করে। কখনও কখনও তাঁর অনুগামীরা তাঁর ট্রেনের টিকিট কেটে দিতেন। মুসলিম, খ্রিস্টান ও নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গেও তিনি একত্রে সে সময় রাত্রিবাস করেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম দিনেই মৃত্যু বরণ করেছিলেন কোন স্বাধীনতা সংগ্রামী?

১৯৯০ সালে তিনি নৈনিতাল, আলমোরা, দেরাদুন, শ্রীনগর, হৃষীকেশ ও হিমালয়ে যান। একেএকে পশ্চিমভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যান। দিল্লীর নানা স্থান দেখে যান আহমেদাবাদ। অয়াধওন, গুজরাতের গিরনা, কচ্ছ, পোরবন্দর, দ্বারকা, মহাবালেশর, কাথিয়াওয়ার, বেলগাঁও, গোয়ার পাঞ্ছিম ও মারগাঁও সেখান থেকে রেলে ধারওয়ার, ব্যাঙ্গালোর। চলে আসেন দক্ষিণ ভারতে। সেখানে মহীশূরের দেওয়ান স্যার কে শেষাদ্রি আইয়ারের সঙ্গে পরিচিত হন। মহীশূররাজ শ্রী চামারাজেন্দ্র ওয়াদিয়ারের রাজপ্রাসাদে থাকেন। পায়ে হেঁটে ত্রিবান্দ্রাম, নেগেরকৈল হয়ে পৌঁছান কন্যাকুমারি। সেটিই এখন বিবেকানন্দ রক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু বিশ্বের দরবারে যাওয়ার আগ্রহ ও সেখানে ভারতের ধর্ম, মানবিকতা, অন্তর্নিহিত নির্যাস প্রচারের প্রয়োজন তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করেছিলেন। পরিব্রাজক হিসাবে বেড়ানোর সময় তিনি বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন।

কন্যাকুমারি থেকে যান মাদুরাই। মাদ্রাজের শিষ্যদের মহীশূরের রামনাদ ও খেত্রির রাজাদের দেওয়ান ও অন্যান্য অনুগামীদের সংগৃহীত অর্থ সাহায্য নিয়ে ১৮৯৩ সালের ৩১ মে আমেরিকার শিকাগোর উদ্দেশ্যে বোম্বাই থেকে জাহাজে ওঠেন। তবে শিকাগোর আগে তিনি ১৮৯৩ সালে জাপানে যান। পৌঁছান নাগাসাকি ও কোবে। সেখান থেকে যান উসাকা, কিয়োটো, টোকিও ও সেখান থেকে যান ইয়োকোহামায়। জাপানের যুদ্ধ বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে দ্রুত উঠে দাঁড়ানো তাঁকে মোহিত করে ছিল। এরপর ১৮৯৩ সালে চীন এবং কানাডা হয়ে পৌঁছান আমেরিকার শিকাগোতে। সেখানে তিনি ধর্ম মহাসভা আয়োজনের খবর আগেই পেয়েছিলেন। কিন্তু, সমস্যা হয়েছিল দু’টি। প্রথমত তাঁর দরকার ছিল ধর্মমহা সম্মেলনে ঢোকার জন্য একটি শংসাপত্র। যা দিতে পারে কোনও খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় ছিল অর্থাভাব। কারণ তখন ধর্ম মহাসভা শুরু হতে  প্রায় দেড়মাস বাকি ছিল। এসময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় জনৈক অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সঙ্গে আলাপ হয়। রাইট তাঁকে হার্ভার্ডে আমন্ত্রণ জানান এবং সেখানে তাঁর বক্তব্যে পান্ডিত্যের ও জ্ঞানের প্রকাশে বিভোর হয়ে যান। তিনি বলেছিলেন, ধর্ম মহাসম্মেলনে যাওয়ার জন্য আপনার কাছে প্রশংসা পত্র চাওয়া হল স্বর্গে সূর্যের আলো দেওয়ার অধিকার চাওয়ার মতো আশ্চর্যের। রাইট তখন শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনের প্রতিনিধিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের কাছে একটি চিঠিতে লেখেন,”আমাদের সকল অধ্যাপক মিলিতভাবে যতটা শিক্ষিত ইনি তাঁদের থেকেও বেশি শিক্ষিত”। সেখানেই তাঁর সুপারিশ মিলে যায়।

১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইন্সটিটিউটে প্রথম বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলন। তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার আগে একটু মানসিক বিচলতা দেখা যায়। কিন্তু, স্মরণ করেন দেবী সরস্বতীর। এরপর শুরু করেন তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্য- “আমেরিকার সমবেত ভগিনী ও ভ্রাতাগন…” তাঁর এই প্রাথমিক সম্ভাষণে সভাগৃহের প্রায় ৭ হাজার দর্শক উঠে দাড়িয়ে দুই মিনিট টানা সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন। তাঁর পূর্ববর্তী বক্তাদের দেওয়া সহিষ্ণুতা ও মহাজাগতিক গ্রহণযোগ্যতা ও সহিষ্ণুতার বিষয়ে শিক্ষালাভ ঘটেছিল প্রাচীন সন্ন্যাসীদের বৈদিক ক্রমানুসারে। তুলে ধরেছিলেন বেদের প্রামান্য ও  জ্ঞানের ভাণ্ডারকে। ইহুদীদের ওপর রোমান আক্রমণ ও ইহুদী মন্দির ধ্বংসের পরে ইহুদী ও পারসিকদের ভারতে আশ্রয় দেওয়ার কথা উল্লেখ করে ভারতের অবদান বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন, বিভিন্ন নদীর স্রোতধারা শেষে সমুদ্রেি মেশে, তেমনই বিভিন্ন প্রবণতার মানুষ শেষপর্যন্ত প্রভুর কাছেই পৌছায়, তা সে যে আকারেই হোক না কেনও।  সভার সভাপতি ড. ব্যারোজ বলেছিলেণ, কমলা সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ ধর্ম সমূহের মাতা, ভারতের  প্রতিনিধিত্ব করেছেন ও শ্রোতাদের ওপর তিনিি সবচেয়ে বেশি বিষয়কর প্রভার বিস্তার করেছেন। সমকালীন পত্রিকায় লেখা হয়, ” বিবেকানন্দ ভারতের সাইক্লোন সন্ন্যাসী”। নিউইয়র্ক হেরাল্ড লেখে, “বিবেকানন্দ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, এই শিক্ষিত জাতির কাছে মিশনারি পাঠানো সবচেয়ে বোকাকামি।”  সেখান থেকে আরও কয়েকটি সভায় বক্তৃতা সেরে মার্কিনমুলুক থেকে সমুদ্র পথে রওনা  দেন ভারতে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজে জাহাজ থেকে নেমে নৌকা করে গঙ্গার ঘাট থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পোঠ হেঁটে বজবজ স্টেশন থেকে ত্রেনে শিয়ালদা ফেরেন, সেখান থেক পায়ে হেঁটে ফেরেন মঠে।  বজবজ থেকে তাঁকে সম্ভাষণ জানাতে দুপাশে ছিল মানুষের ঢল। আর পুষ্পবৃষ্টি করে সম্ভাষণ জানানোর ঢেউ। ইভিএম নিউজ

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর