ব্যুরো নিউজ ২২ জুলাই ২০২৫ : ভারতীয় সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হয়েছে, এবং এর সাথে সাথে আবারও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে ‘জিরো আওয়ার’ (Zero Hour) শব্দটি। প্রশ্নকালের ঠিক পরেই এবং দিনের আইনি কার্যসূচি শুরুর আগে সাংসদদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়টিতে সাংসদরা পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই জনগুরুত্বপূর্ণ জরুরি বিষয়গুলি উত্থাপন করতে পারেন।
জিরো আওয়ার কী?
‘জিরো আওয়ার’ ভারতীয় সংসদের একটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যা ১৯৬২ সালে শুরু হয়েছিল। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে এর উল্লেখ না থাকলেও, এটি সাংসদদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। এই সময়ে, সাংসদরা ১০ দিনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই জনগুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎক্ষণিক বিষয়গুলি উত্থাপন করতে পারেন। সাধারণত, সংসদে কোনো বিষয় উত্থাপন করতে হলে ১০ দিন আগে নোটিশ দিতে হয়, কিন্তু জিরো আওয়ারে এর প্রয়োজন হয় না, কারণ এই বিষয়গুলি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এগুলি এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
এর নাম ‘জিরো আওয়ার’ কেন হলো?
এর নামকরণ ‘জিরো আওয়ার’ হয়েছে কারণ এটি দুপুর ১২টায় শুরু হয়। এটি প্রশ্নকালের পরে এবং নিয়মিত কার্যসূচি শুরুর মধ্যবর্তী সময়। তবে, ২০১৪ সালের পর রাজ্যসভায় জিরো আওয়ারের বিন্যাস কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে, সকাল ১১টায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর প্রথমে জিরো আওয়ার শুরু হয় এবং এর পর দুপুর ১২টায় প্রশ্নকাল শুরু হয়। অভিধানে ‘জিরো আওয়ার’ শব্দের অর্থ হলো ‘সিদ্ধান্তের মুহূর্ত’ বা ‘গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’, এবং সংসদীয় পরিভাষায় এটি সেই সময় যখন সাংসদরা জরুরি বিষয়গুলির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জিরো আওয়ারের সর্বোচ্চ সময়কাল ৩০ মিনিট, এবং প্রতিটি সাংসদ তাদের বিষয় উত্থাপনের জন্য ২-৩ মিনিট সময় পান। তবে, স্পিকার বা চেয়ারম্যানের ইচ্ছানুযায়ী এর সময় বাড়ানো যেতে পারে।
জিরো আওয়ারের সূচনা কখন?
জিরো আওয়ারের সূচনা হয় ১৯৬২ সালে, যখন সাংসদরা অনুভব করেন যে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক গুরুত্বের কিছু জরুরি বিষয় অবিলম্বে সংসদে উত্থাপন করা প্রয়োজন। সে সময় সাংসদরা প্রশ্নকালের পর, কখনও স্পিকারের অনুমতি নিয়ে আবার কখনও অনুমতি ছাড়াই এমন বিষয়গুলি উত্থাপন করতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন তাড়াতাড়ি শুরু হয় এবং প্রশ্নকাল স্থগিত করা হয়, যা জিরো আওয়ারের প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়িয়ে তোলে। নবম লোকসভার স্পিকার রবি রায় জিরো আওয়ারকে আরও সুসংগঠিত করেন। তিনি এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিয়ম তৈরি করেন, যাতে সাংসদরা আরও সুসংবদ্ধ উপায়ে বিষয়গুলি উত্থাপন করতে পারেন এবং সংসদের সময় বাঁচানো যায়।
জিরো আওয়ার কীভাবে কাজ করে?
- প্রথম নোটিশ প্রদান: সাংসদদের জিরো আওয়ারে কোনো বিষয় উত্থাপন করার জন্য সেই দিনের সকাল ১০টার মধ্যে লোকসভার স্পিকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে লিখিত নোটিশ দিতে হয়। এই নোটিশে বিষয়টি স্পষ্ট করতে হয়।
- স্পিকার/চেয়ারম্যান কর্তৃক বিষয় নির্বাচন: স্পিকার বা চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নেন কোন বিষয়টি জিরো আওয়ারে উত্থাপন করা হবে। লোকসভায়, প্রতিদিন ২০টি বিষয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়।
- প্রতি সাংসদের জন্য নির্দিষ্ট সময়: প্রতিটি সাংসদ ২-৩ মিনিট সময় পান। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী উত্তর দিতে পারেন, তবে প্রশ্নকালের মতো জিরো আওয়ারে মন্ত্রীদের উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
জিরো আওয়ারের গুরুত্ব কী?
- জরুরি বিষয়গুলিতে মনোযোগ: জিরো আওয়ার সাংসদদের এমন জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি উত্থাপন করার সুযোগ দেয়, যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সন্ত্রাসবাদ বা নীতি ঘোষণা।
- সরকারের জবাবদিহিতা: এটি সরকারকে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে অবিলম্বে সাড়া দিতে বাধ্য করে। যদিও মন্ত্রীদের উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, তবে এই প্ল্যাটফর্ম সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
- গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ: জিরো আওয়ার সাংসদদের জনসাধারণের কণ্ঠস্বর সংসদে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ দেয়, যার ফলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়।
জিরো আওয়ারের চ্যালেঞ্জগুলি কী কী?
- সংসদে বিঘ্ন: অনেক সময়, জিরো আওয়ারে উত্থাপিত বিষয়গুলি সংসদের কার্যপ্রণালীতে বিঘ্ন ঘটায়, কারণ সাংসদরা আবেগপ্রবণ বা বিতর্কিত বিষয় উত্থাপন করেন।
- সীমিত সময়: ৩০ মিনিটের সময়কালে সব সাংসদকে সুযোগ দেওয়া কঠিন, যদিও কখনও কখনও এর সময় বাড়ানো হয়।
- অনানুষ্ঠানিক প্রকৃতি: যেহেতু এটি নিয়ম বইতে অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই এর অপব্যবহারের সম্ভাবনাও থাকে।
এইভাবে, ‘জিরো আওয়ার’ সাংসদদের জনসাধারণের কণ্ঠস্বর অবিলম্বে সংসদে পৌঁছে দেওয়ার একটি সুযোগ করে দেয়। এটি গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সরকারকে জবাবদিহী করে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সামনে আনে। তবে, এটিকে আরও কার্যকর করতে সময় এবং নিয়মগুলিকে আরও সুসংগঠিত করার প্রয়োজন রয়েছে।