ব্যুরো নিউজ ২৬ মে : আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে, ‘বিবাহের সঠিক বয়স’ নিয়ে প্রশ্নটি যেন ঐতিহ্য আর বিভ্রান্তিতে মোড়া এক ধাঁধা। বাবা-মা বলেন, “২৫-এর মধ্যে গৃহস্থ হও।” বন্ধুরা বলে, “আগে জীবনটা উপভোগ করো।” সোশ্যাল মিডিয়া বলে, “পার্টনারকে সফট লঞ্চ করো, লাইফস্টাইলকে হার্ড লঞ্চ করো।” কিন্তু এই সব কোলাহলের গভীরে লুকিয়ে আছে একটি মৌলিক প্রশ্ন: বিয়ের সঠিক বয়স কোনটি?

আমরা কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর পাব না। এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞান। আর জ্ঞানের এমন গভীর উৎস সম্ভবত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ছাড়া আর কোথাও নেই। শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের কালজয়ী এই কথোপকথন জীবনের প্রতিটি কোণায় আজও অনুরণিত হয়। আসুন, এই পবিত্র গ্রন্থে ডুব দিয়ে দেখি, এর শাশ্বত অন্তর্দৃষ্টি কীভাবে আমাদের এই আধুনিক সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করতে পারে।


অধ্যায় ১: “নিখুঁত বয়স”-এর বিভ্রম

সমাজ “আদর্শ বয়স”-কে একটি নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার ভিত্তিক অনুষ্ঠানের মতো করে বেঁধে দিতে চেষ্টা করেছে। বহু দশক ধরে, মানুষ মনে করত ২০-এর গোড়ার দিকটা ছিল বিয়ের জন্য আদর্শ সময়—বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। এখন, মানসিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে, অনেকে বলেন ২৫-এর শেষ বা ৩০-এর শুরুই ভালো। কেউ বলেন আগে বিয়ে করা বুদ্ধিমানের কাজ; কেউ আবার দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পক্ষে সওয়াল করেন।

কিন্তু শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বছরের কথা বলে না—এটি যোগ (পথ), গুণ (বৈশিষ্ট্য) এবং ধর্ম (উদ্দেশ্য) নিয়ে কথা বলে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করেননি, “যুদ্ধ করার জন্য তোমার কি সঠিক বয়স হয়েছে?” তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তুমি কি তোমার ধর্ম পালনের জন্য প্রস্তুত?”

বিবাহ, গীতার যুদ্ধের মতোই, বয়সের ব্যাপার নয়। এটি হলো নিজেকে, নিজের উদ্দেশ্যকে এবং নিজের বৃদ্ধিকে সারিবদ্ধ করার বিষয়। তাই, “কত বয়স?” না হয়ে প্রশ্নটি হওয়া উচিত: আধ্যাত্মিকভাবে, আবেগিকভাবে, মানসিকভাবে আপনি জীবনের কোন পর্যায়ে আছেন?

প্রেম কি কেবল মায়া? গীতার গভীরে ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ


অধ্যায় ২: ধর্ম – অভ্যন্তরীণ দায়িত্বের আহ্বান

গীতায় ধর্ম হলো মহাজাগতিক দিকনির্দেশক। এটি আপনার প্রকৃত ভূমিকা, আপনার জীবনের দায়িত্ব—সমাজ আপনার কাছ থেকে যা চায় তা নয়, বরং আপনার আত্মা যা করতে চায়, জানে।

শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন: “পরের ধর্ম সফলভাবে পালনের চেয়ে নিজের ধর্মে ব্যর্থ হওয়াও ভালো।” (গীতা ৩.৩৫)

বিবাহের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি সমাজের কথায় বিয়ে করেন, আপনার আত্মার সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও, তবে আপনি অন্যের ধারণায় জীবন যাপন করার ঝুঁকি নেন।

তাহলে, আপনি কি আবেগিকভাবে স্থিতিশীল? আপনার মূল্যবোধ সম্পর্কে কি আপনি স্পষ্ট? আপনি কি প্রতিশ্রুতির অর্থ বোঝেন—শৃঙ্খল হিসাবে নয়, বরং নির্বাচিত বৃদ্ধি হিসাবে?

যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি প্রস্তুত হতে পারেন—আপনার বয়স ২২ হোক বা ৩২। যদি উত্তর না হয়, তবে অপেক্ষা করা ঠিক আছে। গীতা আমাদের শেখায়: স্পষ্টতা ছাড়াই কোনো ফলাফলের দিকে ছুটে যাওয়া দুঃখের কারণ হয়।


অধ্যায় ৩: মিলনের আগে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ

গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ এমন যোগীর কথা বলেছেন যিনি আত্ম-নিয়ন্ত্রিত, সুশৃঙ্খল এবং সব পরিস্থিতিতে ভারসাম্য বজায় রাখেন। ইনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি আনন্দ বা বেদনা, খ্যাতি বা ব্যর্থতা দ্বারা প্রভাবিত হন না।

বিবাহের মতো একটি আজীবন সম্পর্কে প্রবেশ করার আগে এই আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাস্তব কথা হলো: বিবাহ সবসময় মোমবাতির আলোয় রাতের খাবার আর ‘কাপল গোলস’ নিয়ে হয় না। এটি আপস, ঝড়, কঠিন কথাবার্তা এবং গভীর রাতের “আমরা কি ঠিক আছি?” মুহূর্তগুলি নিয়েও হয়।

আত্ম-নিয়ন্ত্রণ মানে আপনি আপনার শূন্যতা পূরণের জন্য সঙ্গীর উপর নির্ভর করেন না—আপনি আপনার পূর্ণতাকে টেবিলে নিয়ে আসেন।

সুতরাং, গীতা জিজ্ঞাসা করবে: আপনি কি এখনও আপনার পরিপূরক খুঁজছেন? নাকি আপনি নিজেকে এতটাই সম্পূর্ণ করেছেন যে আপনি আপনার জীবন কারো সাথে ভাগ করে নিতে পারেন?

বিবাহ তখন প্রয়োজন না হয়ে একটি উপহারে পরিণত হয়।


অধ্যায় ৪: অনাসক্তি – আঁকড়ে না ধরে ভালোবাসা

গীতা দর্শনের আরেকটি স্তম্ভ হলো অনাসক্তি—ভালোবাসা থেকে নয়, বরং অহং-বদ্ধ সম্পর্কের আঁকড়ে থাকার প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।

শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন: “ভালোবাসার সাথে কাজ করো, কিন্তু ফলাফলের প্রতি আসক্তি ছাড়া।” (গীতা ২.৪৭)

এটি সম্পর্কের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারে। একাকীত্বের ভয়ে বিয়ে করবেন না। “আপনার বন্ধুরা ইতিমধ্যেই বিয়ে করে ফেলেছে” এই কারণেও নয়। কেবলমাত্র রোমান্টিক উচ্ছ্বাসের জন্যও বিয়ে করবেন না। বিয়ে করুন কারণ আপনি স্বাধীনভাবে, গভীরভাবে এবং নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কাউকে ভালোবাসতে শিখেছেন। বিবাহ দখল করার বিষয় নয়। এটি হলো বিবর্তন—দুটি আত্মা পাশাপাশি পথে হাঁটা, একজন অন্যকে টেনে নিয়ে যাওয়া নয়।


অধ্যায় ৫: তিন গুণ এবং সঙ্গী নির্বাচন

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা তিন গুণের কথা বলে—সত্ত্ব (বিশুদ্ধতা), রজঃ (আবেগ) এবং তমঃ (স্থিরতা)। এগুলি আমাদের সবার মধ্যে বিভিন্ন অনুপাতে বিদ্যমান এবং আমাদের কাজ, পছন্দ এবং সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে।

একটি তমঃ-ভিত্তিক বিবাহ অলসতা, সামাজিক চাপ বা একা থাকার ভয়ে গঠিত হতে পারে। একটি রজঃ-ভিত্তিক বিবাহ কেবল আতশবাজি, রসায়ন এবং নাটক নিয়ে হতে পারে—তবে এতে প্রায়শই দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার অভাব থাকে। একটি সত্ত্ব-ভিত্তিক বিবাহ শান্তি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আধ্যাত্মিক সঙ্গের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: বিয়ে করার আপনার আকাঙ্ক্ষা কি সামাজিক কোলাহল না অভ্যন্তরীণ সত্যের উপর ভিত্তি করে? আপনার সঙ্গী কি এমন কেউ যিনি স্পষ্টতা আনেন নাকি বিশৃঙ্খলা? আপনি কি সচেতনতার সাথে বিবাহে প্রবেশ করছেন নাকি আসক্তির সাথে?

গীতা একটি সাত্ত্বিক মিলনকে উৎসাহিত করবে—যা উভয় সঙ্গীকে উচ্চতর বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে।


অধ্যায় ৬: অর্জুনের দ্বিধা আমাদের দ্বিধা

মনে রাখবেন: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা নিজেই অর্জুনের সংশয় দিয়ে শুরু হয়েছে। তিনি সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি কর্তব্য এবং ইচ্ছার মধ্যে, হৃদয় এবং মনের মধ্যে বিভক্ত অনুভব করেন।

বিবাহ নিয়ে ভাবলে আমাদের অনেকেই কি এই পরিস্থিতিতে থাকি না? আমাদের কেউ কেউ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে ভয় পান। কেউ কেউ ভয় পান যে তারা কিছু হারাচ্ছেন। কেউ কেউ কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসেন কিন্তু সঠিক সময় কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত নন।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের ভয়কে খারিজ করেননি। তিনি শুনেছেন। তারপর তাকে কর্মের মাধ্যমে স্পষ্টতার দিকে পরিচালিত করেছেন।

একইভাবে, যদি আপনি বিবাহ নিয়ে বিভ্রান্ত হন, গীতা বলবে: ভয়ে কাজ করবেন না। ভয়ে অপেক্ষা করবেন না। অভ্যন্তরীণ নীরবতা, আত্ম-অধ্যয়ন, ধ্যান এবং হ্যাঁ—সাহসের মাধ্যমে স্পষ্টতা খোঁজুন।

বেদে মাংস ভক্ষণের সমর্থন নেই – প্রমাণসহ তথ্য !


অধ্যায় ৭: আত্মিক সঙ্গীরা এবং রোম্যান্সের বাইরে যাত্রা

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা রোমান্টিক প্রেমের কথা খুব কমই বলে, তবে এটি আত্মা এবং ঐশ্বরিকের মধ্যে ভালোবাসার কথা অবিরাম বলে।

হয়তো এটি বিবাহকে দেখার একটি উচ্চতর উপায়—একটি লেনদেন হিসাবে নয়, কেবল সঙ্গ হিসাবে নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক সাধনা হিসাবে। একটি ভালো বিবাহ নিজেই একটি সবসময়ের নির্দেশনা হয়ে ওঠে —পথনির্দেশক, প্রশ্নকারী, সহায়তাকারী। আর কখনও কখনও, আপনিও নির্দেশক হয়ে ওঠেন—চ্যালেঞ্জকারী, প্রতিফলক, প্রেমময়। আপনি কেবল আরামেই নয়, চেতনায়ও বেড়ে ওঠেন।

সুতরাং, জিজ্ঞাসা করবেন না: “আমার কি সঠিক বয়স হয়েছে?” জিজ্ঞাসা করুন: “আমি কি সঠিক আত্মা হয়ে উঠছি?”


অধ্যায় ৮: আধুনিক বাস্তবতা, প্রাচীন জ্ঞান

আসুন এটিকে বর্তমানের সাথে মেলানো যাক। আমরা কর্মজীবনের চাপ, শহুরে একাকীত্ব, ডেটিং অ্যাপস এবং অফুরন্ত বিকল্পের বিশ্বে বাস করছি। তাহলে গীতা কীভাবে এতে মানানসই হয়?

পুরোপুরিভাবে। কারণ গীতা কখনই নিয়ম সম্পর্কে ছিল না—এটি ছিল অভ্যন্তরীণ বিপ্লব সম্পর্কে।

এটি আপনাকে বলবে না কখন বিয়ে করতে হবে। তবে এটি পথ নির্দেশ করে বলবে: ভয়ে বিয়ে করবেন না। নিজেকে এড়াতে বিয়ে করবেন না। মানিয়ে নিতে বিয়ে করবেন না। বিয়ে করুন কারণ আপনি নিজের মধ্যে শান্তি খুঁজে পেয়েছেন—এবং এখন আপনি তা ভাগ করে নিতে চান।

কেউ ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করে সফল হন। কেউ ৩৫ বছর বয়সে। কেউ কখনও বিয়ে করেন না—তবুও তারা সমৃদ্ধ, অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করেন।

সঠিক বয়স তখনই যখন আপনার হৃদয় জাগ্রত, আপনার মন স্পষ্ট এবং আপনার আত্মা সুপ্রতিষ্ঠিত।

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর