ব্যুরো নিউজ ২৭ মে : ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ভারতীয় বিমানবাহিনীর ঐতিহাসিক ‘অপারেশন সফেদ সাগর’-এর ২৬তম বার্ষিকী উদযাপন করছে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স (IAF)। ২৬ মে, ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া এই অভিযানটি ভারতীয় সামরিক ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল এবং IAF এটিকে ‘বহু দিক থেকে পথপ্রদর্শক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
অপারেশন: উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট
‘অপারেশন সফেদ সাগর’ ছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর আকাশ অভিযানের ছদ্মনাম, যা ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময় স্থলবাহিনীকে সমর্থন করার জন্য চালু করা হয়েছিল। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর ভারতীয় সেনা অবস্থান দখল করে থাকা “পাকিস্তানি নিয়মিত সেনা ও অনুপ্রবেশকারীদের” বিতাড়িত করা। ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘অপারেশন বিজয়’-এর অধীনে স্থলপথে অভিযান চালাচ্ছিল, আর বিমানবাহিনী তাদের আকাশপথে সহায়তা প্রদান করছিল। X-এ (পূর্বে ট্যুইটার) করা একটি পোস্টে IAF লিখেছে, “অপারেশন সফেদ সাগর… ‘অপারেশন বিজয়’-এর অধীনে স্থলবাহিনীকে সমর্থন করার জন্য চালু করা হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল কারগিল সেক্টরে LoC বরাবর ভারতীয় অবস্থান দখল করে থাকা পাকিস্তানি নিয়মিত সেনা ও অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করা।”
উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও চ্যালেঞ্জ
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর কাশ্মীর অঞ্চলে এই প্রথম এত বড় আকারের বিমানবাহিনীর ব্যবহার হয়েছিল। এই অভিযানটি শুধুমাত্র তার বৃহৎ আকারের ব্যবহারের জন্যই নয়, বরং এর প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থার কারণেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। IAF উল্লেখ করেছে, “এর আগে কোনো বিমানবাহিনীকে এমন দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে এত উচ্চ-উচ্চতায় নির্ভুল অভিযান চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি—যা সামরিক বিমান চলাচলের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত তৈরি করেছিল।” কারগিলের উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং প্রতিকূল আবহাওয়া বিমানবাহিনীর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল, যেখানে বিমান চলাচলের সময় অক্সিজেনের অভাব এবং অপ্রত্যাশিত বাতাস একটি বড় সমস্যা ছিল।
অপারেশনের সাফল্য ও অর্জন
‘অপারেশন সফেদ সাগর’ ভারতীয় সামরিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত। এই অপারেশনটি বহু দিক থেকে একটি পথপ্রদর্শক ছিল। IAF এর অর্জনের বিষয়ে বলেছে:
- অপ্রচলিত ভূমিকায় বিমানশক্তির ব্যবহার: এটি বিমানবাহিনীর প্রচলিত ভূমিকার বাইরে গিয়ে কৌশলগত অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছিল।
- সীমিত সংঘাতে কার্যকারিতা: একটি সীমিত তীব্রতার সংঘাতে বিমান সম্পদের সীমিত ব্যবহারের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছিল।
- যুদ্ধের ধারণা পরিবর্তন: দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত এই ধারণা ভেঙে দিয়েছিল যে বিমানবাহিনীর ব্যবহার অনিবার্যভাবে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপান্তরিত হবে।
- প্রতিরোধমূলক মূল্য স্থাপন: এটি প্রমাণ করেছিল যে নিয়ন্ত্রিত বিমান হামলা, এমনকি নিম্ন-তীব্রতার সংঘাতেও, শত্রুর উপর প্রতিরোধমূলক প্রভাব ফেলতে পারে।
- যুদ্ধক্ষেত্রের মোড় ঘোরানো: এই অভিযান প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম না করেও বিমানশক্তি যুদ্ধের গতিপথ নির্ণায়কভাবে পরিবর্তন করতে পারে।
এই অপারেশনটি শুধুমাত্র ভারতীয় বিমানবাহিনীর বহুমুখী ক্ষমতা এবং সংকল্পই প্রদর্শন করেনি, বরং সামরিক কৌশল এবং বিমানবাহিনীর ভূমিকার বিষয়ে একটি নতুন ধারণা তৈরি করেছিল।
ব্যবহৃত সরঞ্জাম
২৬ মে, ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া ‘অপারেশন সফেদ সাগর’-এ ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের অত্যাধুনিক এবং নির্ভরযোগ্য বিমানগুলি ব্যবহার করেছিল। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, IAF এই অভিযানে নিম্নলিখিত বিমানগুলি ব্যবহার করে:
- যুদ্ধবিমান: মিরাজ ২০০০, মিগ ২১, জাগুয়ার, মিগ ২৩, মিগ ২৭, এবং মিগ ২৯।
- হেলিকপ্টার: মি ১৭ (Mi-17), চেতক।
এই অভিযানে প্রায় ৫০০টি স্ট্রাইক মিশন, ৩৫০টি রিকনেসান্স/ইএলআইএনটি ( শত্রু শিবিরের তথ্য সংগ্রহ ) অভিযান এবং প্রায় ৮০০টি এসকর্ট ( সহায়ক) ফ্লাইট চালানো হয়েছিল। এছাড়া, যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় হতাহতদের সরিয়ে নেওয়া এবং বিমান পরিবহনের জন্য ২০০০-এর বেশি হেলিকপ্টার সর্টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বিমানগুলির কার্যকরী ব্যবহার কারগিল যুদ্ধে ভারতের বিজয়ে এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিল।
‘অপারেশন সফেদ সাগর’ আজও ভারতের বিমানবাহিনীর সাহসিকতা, দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এটি ভারতের সামরিক সক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা ভবিষ্যৎ সামরিক অভিযানগুলির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করেছে।