ব্যুরো নিউজ ১৫ জুলাই ২০২৫ : বছরের পর বছর ধরে সংঘাত আর অস্থিরতায় জর্জরিত ‘ভূস্বর্গ’ কাশ্মীর। তবে এই বিশৃঙ্খলা আর অনিশ্চয়তার মাঝে, দীর্ঘ ৩০ বছর পর উলার লেকে পদ্মফুলের পুনরাগমন যেন উপত্যকায় এক নতুন আশা আর আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছে। একসময়ের প্রস্ফুটিত পদ্মফুলগুলি ১৯৯২ সালের বন্যার পর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
উলার লেকের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
ভারতের বৃহত্তম স্বাদু জলের হ্রদ হলো উলার লেক, যা কাশ্মীরের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। সোপোর এবং বান্দিপোরা শহরের মাঝে অবস্থিত ২০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি আয়তনের এই হ্রদটি স্থানীয় বাসিন্দাদের আয়ের এক অপরিহার্য উৎস। তবে, ১৯৯২ সালের বিধ্বংসী বন্যার পর থেকে বিভিন্ন পরিবেশগত কারণ এবং মানুষের কার্যকলাপের কারণে হ্রদটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জৌলুস কমতে শুরু করে। একসময়ের প্রস্ফুটিত পদ্মফুলগুলো হারিয়ে গিয়েছিল, হ্রদটি হয়ে উঠেছিল আবর্জনাপূর্ণ ও অস্বচ্ছ।
৩৭০ ধারা বাতিলের পর এক অলৌকিক প্রত্যাবর্তন
তবে, উপত্যকায় ৩৭০ ধারা বাতিলের পর এক নাটকীয় মোড় নিয়ে ৩০ বছর পর উলার লেকে আবার পদ্মফুলের প্রস্ফুটন শুরু হয়েছে। এই অসাধারণ ঘটনায় হ্রদের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আনন্দ ও আশার সঞ্চার হয়েছে।
কাশ্মীরে পদ্মফুলের গভীর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। এটিকে প্রায়শই “কাশ্মীরের রানী” হিসাবে উল্লেখ করা হয় এবং এটি স্থিতিস্থাপকতা, সৌন্দর্য এবং বিশুদ্ধতার প্রতীক। উলার লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি, পদ্মফুলের এই প্রত্যাবর্তন কাশ্মীরি মানুষের জন্য গভীর তাৎপর্য বহন করে।
পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার সুফল
পদ্মের এই পুনরুজ্জীবনের জন্য উলার লেক ম্যানেজমেন্ট অথরিটির চলমান ডিসিল্টিং (পলি অপসারণ) এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্পকে কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর ২০২০ সালে শুরু হওয়া এই প্রচেষ্টার লক্ষ্য হলো ঝিলাম নদী এবং এর উপনদীগুলো থেকে বয়ে আসা পলি ও বর্জ্য অপসারণ করে হ্রদের আসল গভীরতা ফিরিয়ে আনা এবং জলের প্রবাহ উন্নত করা।
স্থানীয় বাতলাব গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ ইয়াকুব কাশ্মীরের এক স্থানীয় সংবাদ সংস্থাকে বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম এটি আর কখনোই ফিরে আসবে না।” উলার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের একজন জোনাল অফিসার মুদাসির আহমেদ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, “যেসব এলাকায় আমরা গত কয়েক বছর ধরে পলি অপসারণ করেছি, সেসব এলাকায় পদ্মের পুনরুজ্জীবন দেখা গেছে। যেহেতু পদ্মের বীজ মাটির গভীরে পলি জমে চাপা পড়েছিল, তাই সেগুলো জন্মাতে পারছিল না। এখন পলি অপসারণ হওয়ায় আবার পদ্ম জন্মেছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমার বাবা এখানে পদ্মের ডাঁটা সংগ্রহ করতেন। আমি ছোটবেলায় তাকে সাহায্য করতাম। তারপর বন্যা এলো এবং সবকিছু বদলে গেল।”
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী: ঐতিহাসিক রেল সংযোগের স্বপ্ন পূরণ, চেনাব সেতুর উদ্বোধনে মোদীর বার্তা
পুনরায় অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের সম্ভাবনা
ঐতিহ্যবাহী কাশ্মীরি রান্নার এক প্রধান উপাদান হলো পদ্মের ডাঁটা, যা বিশেষ করে তীব্র শীতকালে, যখন আয়ের অন্য কোনো উৎস থাকে না, তখন মৌসুমী কাজের সুযোগ দিত। উপত্যকার ডাল লেক এবং মানসবল লেকেও পদ্ম দেখা যায়।
আধিকারিকরা জানিয়েছেন, কয়েক দশক ধরে পদ্মের ডাঁটা দেখা না গেলেও, উদ্ভিদের মূল কাঠামো পলির নিচে চাপা পড়ে ছিল। মুদাসির আহমেদ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে আরও বলেন, “যেসব এলাকায় আমরা গত কয়েক বছর ধরে পলি অপসারণ করেছি, সেসব এলাকায় পদ্মের পুনরুজ্জীবন দেখা গেছে। যেহেতু পদ্মের বীজ মাটির গভীরে পলি জমে চাপা পড়েছিল, তাই সেগুলো জন্মাতে পারছিল না। এখন পলি অপসারণ হওয়ায় আবার পদ্ম জন্মেছে।”
আধিকারিকদের মতে, পলি অপসারণ প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ৭.৯ মিলিয়ন ঘনমিটারের বেশি পলি হ্রদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। যেসব স্থানে এ বছর ড্রেজিং শেষ হয়েছে, কর্তৃপক্ষ সেখানে পদ্মের বীজ রোপণ করেছে। সংরক্ষণ পরিকল্পনার সাথে জড়িত কর্তৃপক্ষগুলির মতে, বৃহত্তর উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতে হ্রদে পলি এবং বর্জ্য প্রবেশ রোধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্রোতগুলির পাশে ধারণ বেসিন নির্মাণ করা।
লাহারওয়ালপোরার বাসিন্দা জাহুর আহমেদ বলেন, “আমরা অনেকবার হ্রদে বীজ ফেলেছিলাম, কিন্তু কিছুই বাড়েনি। পলি পরিষ্কার করার পরেই এখন আমরা আবার ফুলগুলি দেখতে পাচ্ছি।” আহমেদ সংবাদ সংস্থাকে আরও জানান, “পদ্মের প্রত্যাবর্তন কেবল পরিবেশগত উন্নতির লক্ষণ নয়, এটি হ্রদের আশেপাশে অনেক পরিবারের জন্য নবায়িত অর্থনৈতিক কার্যকলাপেরও একটি উৎস।”
১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে কাশ্মীরে ভয়াবহ বন্যা প্রচুর পলি জমা করেছিল, যা পদ্মের গাছপালা ঢেকে ফেলে এবং উলার লেকের সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্রের গুরুতর ক্ষতি সাধন করে। এই পদ্মের প্রত্যাবর্তন এখন কাশ্মীরের পরিবেশগত পুনরুদ্ধার এবং স্থানীয় অর্থনীতির জন্য এক নতুন আশার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।