Jagdeep Dhankhar resigns

ব্যুরো নিউজ ২২ জুলাই ২০২৫ : সোমবার সন্ধ্যায় আকস্মিকভাবে উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখর তাঁর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে জানিয়েছেন যে, স্বাস্থ্যগত কারণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে তিনি অবিলম্বে এই পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। তার এই পদত্যাগ এমন এক সময়ে এলো, যখন বর্ষা অধিবেশনের প্রথম দিন শেষ হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। দিনের শুরুতেই ধনখর রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৭৪ বছর বয়সী ধনখর ২০২২ সালের আগস্টে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

পদত্যাগের ঘোষণা ও কারণ:

রাষ্ট্রপতিকে লেখা চিঠিতে ধনখর উল্লেখ করেছেন, “স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দিতে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে, সংবিধানের ৬৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে, আমি অবিলম্বে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছি।” তিনি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে তার অবিচল সমর্থন এবং কার্যকালে বজায় রাখা চমৎকার কাজের সম্পর্কের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। উপরাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মন্ত্রী পরিষদকেও তার গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা ও সমর্থন অমূল্য ছিল, এবং আমি আমার কার্যকালে অনেক কিছু শিখেছি।”

Lok Sabha : সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু ২১ জুলাই, ভারত সরকারের এজেন্ডায় ৮টি নতুন বিল


জগদীপ ধনখরের কর্মতত্পর কার্যকাল (২০২২-২০২৫):

২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভারতের ১৪তম উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জগদীপ ধনখরের কার্যকাল প্রায়শই বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ ছিল। ২০২২ সালের আগস্টে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়ে, ধনখরের মেয়াদে তার স্পষ্টভাষী মতামত, সংসদীয় কার্যধারার সিদ্ধান্ত এবং বিরোধী দলগুলির সাথে উত্তেজনার কারণে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা গেছে। তার কার্যকালকে সংজ্ঞায়িত করা কিছু মূল সংঘাত ও সমস্যা নিচে দেওয়া হলো:

১. বিচার বিভাগের ক্ষমতার প্রশ্ন: জানুয়ারী ২০২৩-এ, ধনখর সুপ্রিম কোর্টের “মৌলিক কাঠামো” মতবাদ নিয়ে তার মন্তব্যের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক ঝড় তোলেন। তিনি বলেন যে, বিচার বিভাগ যদি সংসদ কর্তৃক পাসকৃত আইন বাতিল করে, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। এই মন্তব্যকে বিরোধী দলগুলি বিচারিক স্বাধীনতাকে দুর্বল করার চেষ্টা হিসেবে ব্যাপক সমালোচনা করে। কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা তাকে বিচার বিভাগের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ এবং ক্ষমতাসীন সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার অভিযোগ করেন। জয়রাম রমেশের মতো বিরোধী ব্যক্তিত্বরা তার বক্তব্যকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেন, অন্যরা ক্ষমতাসীন বিজেপি এজেন্ডার প্রতি তার সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্বের দিকে ইঙ্গিত করেন।

২. ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে মন্তব্য: মার্চ ২০২৩-এ, ধনখরের ছাত্র রাজনীতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিয়ে মন্তব্য আবারও বিতর্কের জন্ম দেয়। তিনি নির্দিষ্ট কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশবিরোধী মতাদর্শের কেন্দ্রস্থল বলে অভিযুক্ত করেন, যা জেএনইউ-এর মতো ক্যাম্পাসগুলির সরাসরি ইঙ্গিত হিসাবে দেখা হয়। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলি তার এই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে, তাকে আরএসএস এজেন্ডার পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ করে। তার মন্তব্য একাধিক বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে পড়ে, যারা এটিকে শিক্ষাক্ষেত্রে ভিন্নমতকে নীরব করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছিল।

৩. সংসদে বিরোধী দল পরিচালনার বিতর্ক: ধনখরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিযোগগুলির মধ্যে একটি ছিল রাজ্যসভার সভাপতিত্ব করার সময় তার কথিত পক্ষপাতিত্ব। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, বিরোধী দলগুলি তাকে তাদের কণ্ঠস্বর দমন করার এবং সংসদীয় কার্যধারায় বিজেপি সাংসদদের প্রতি অযাচিত অগ্রাধিকার দেওয়ার অভিযোগ করে। মল্লিকার্জুন খাড়গের মতো বিরোধী নেতারা দাবি করেন যে, ধনখর একজন নিরপেক্ষ স্পিকারের চেয়ে বেশি বিজেপির মুখপাত্রের মতো কাজ করছেন। এই অভিযোগগুলি তার চেয়ারম্যান হিসেবে আচরণের পক্ষপাতিত্বের ক্রমবর্ধমান ধারণার জন্ম দেয়।

৪. ‘গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি’ মন্তব্য: মে ২০২৪-এ, ধনখর গণতন্ত্র নিয়ে তার বক্তব্য দিয়ে আরেকটি বিতর্কের সৃষ্টি করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন যে, কিছু উপাদান গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা উচিত। তার মন্তব্যকে বিরোধী দলগুলির, বিশেষ করে যারা অধিবেশন বয়কট করছে বা সরকারের নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, তাদের উপর একটি পরোক্ষ আক্রমণ হিসাবে দেখা হয়েছিল। বিরোধী দলগুলি তার এই মন্তব্যের তীব্র আপত্তি জানায়, দাবি করে যে এই ধরনের মন্তব্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক বিরোধিতাকে অবৈধ করার প্রচেষ্টা।

৫. সিবিআই ও ইডি’র প্রতি সমর্থন: অক্টোবর ২০২৪-এ, ধনখর সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এর প্রতি তার সমর্থনের জন্য সমালোচিত হন, এই দুটি কেন্দ্রীয় সংস্থা প্রায়শই রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনি প্রকাশ্যে এই সংস্থাগুলিকে সমর্থন করে বলেন যে, তাদের প্রশ্ন করা বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে। বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে এএপি, এটিকে রাজনৈতিক বিরোধীদের লক্ষ্য করতে এই সংস্থাগুলির সরকারি ব্যবহারের অনুমোদন হিসেবে দেখেছে, যা ধনখর এবং বিরোধীদের মধ্যে আরও উত্তেজনা বাড়িয়েছে।

৬. জয়া বচ্চন ঘটনা: আগস্ট ২০২৪-এ, ধনখর এবং জয়া বচ্চনের মধ্যে সংঘাত একটি বড় বিতর্ক তৈরি করে। একটি অধিবেশন চলাকালীন, ধনখর সমাজবাদী পার্টির সাংসদকে “জয়া অমিতাভ বচ্চন” বলে উল্লেখ করেন, যা নিয়ে তিনি আপত্তি জানান। বচ্চন তার সুরের সমালোচনা করে এটিকে “অগ্রহণযোগ্য” বলে অভিহিত করেন। ধনখর, পাল্টা, সংসদে শিষ্টাচারের গুরুত্ব তুলে ধরে তার আচরণের পক্ষে সাফাই দেন। বিরোধী সাংসদরা প্রতিবাদ করলে এই ঘটনা আরও বড় আকার ধারণ করে, এবং বিরোধী দল অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করে, ধনখরকে অসদাচরণের অভিযোগ করে। এটি এমন অনেক ঘটনার মধ্যে একটি যেখানে উপরাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব এবং বিরোধীদের দুর্বল করার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

৭. আস্থা ভোট ও অনাস্থা প্রস্তাব: ডিসেম্বর ২০২৪-এ, ধনখর কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং আরও কয়েকটি দল নিয়ে গঠিত বিরোধী জোট দ্বারা উত্থাপিত একটি অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হন। বিরোধী দল তাকে বিজেপির মুখপাত্র এবং তার ভূমিকায় নিরপেক্ষতার অভাবের অভিযোগ করে। যদিও প্রস্তাবটি ব্যর্থ হয়, এটি তার প্রতি বিরোধীদের ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিফলিত করে।

৮. জাতীয় নিরাপত্তা ও পাকিস্তানের উপর কঠোর অবস্থান: ধনখর জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে, বিশেষ করে পাকিস্তান সম্পর্কিত বিষয়ে, কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। মে ২০২৫-এ, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি মধ্যস্থতা করার দাবি করেন, তখন ধনখর তীব্রভাবে এই দাবিকে সমালোচনা করেন, জোর দিয়ে বলেন যে ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ অ-আলোচনাযোগ্য। ভারতের জাতীয় স্বার্থের তার দৃঢ় প্রতিরক্ষা কিছু মহলে ভালোভাবে গৃহীত হয়েছিল কিন্তু তার জাতীয়তাবাদী বাগ্মীতার আরেকটি উদাহরণ হিসাবেও দেখা হয়েছিল।

Lok Sabha : ‘জিরো আওয়ার’ কী? ভারতীয় সংসদে এর গুরুত্ব ও কার্যকারিতা

৯. কৃষক সংকট ও সরকারের জবাবদিহিতা: ২০২৪ সালে, ধনখর কৃষক সংকট নিয়েও কথা বলেন। একটি বক্তৃতায়, তিনি প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও কৃষকদের দুর্দশা মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করেন। তার মন্তব্য ক্ষমতাসীন সরকার এবং মাঠের বাস্তবতার মধ্যে একটি সংযোগহীনতার ইঙ্গিত দেয় বলে মনে হয়েছিল। তবে, তার মন্তব্য সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটি বিরল উদাহরণ হিসাবে দেখা হয়েছিল এবং কিছু লোক এটিকে কৃষকদের অধিকারের পক্ষে একটি সাহসী অবস্থান হিসাবে প্রশংসা করেছিল।

পদত্যাগ: এক সক্রিয় কার্যকালের আকস্মিক সমাপ্তি:

২০২৫ সালের ২১শে জুলাই, ধনখর স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দেন। তার পদত্যাগ আকস্মিক ছিল এবং সংসদের বর্ষা অধিবেশন শুরুর ঠিক আগে ঘটেছিল। যদিও তার স্বাস্থ্যগত অবস্থা সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি, তবে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে যে তিনি সাম্প্রতিক মাসগুলিতে স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ছিলেন। এই অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ তার উত্তাল কার্যকালের অবসান ঘটায়, যেখানে তার সমালোচক এবং সমর্থক উভয়ই তার বিতর্কিত কিন্তু ঘটনাবহুল সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।

জগদীপ ধনখর উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার পূর্বে, ২০১৯ থেকে ২০২২ অবধি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের দায়িত্বে ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর