ব্যুরো নিউজ ২৮ মে : অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধারের বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে, সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) এই সপ্তাহে নিশ্চিত করেছে যে ইন্টারপোল ভারতের অনুরোধে তাদের প্রথম দুটি ‘সিলভার নোটিশ’ জারি করেছে। এটি ইন্টারপোলের নতুন এক ধরণের সতর্কতা, যা অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ খুঁজে বের করতে সাহায্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই নোটিশগুলি আন্তর্জাতিকভাবে সম্পদ খুঁজে বের করার প্রচেষ্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ চিহ্নিত করে। এর মাধ্যমে ভারত সহ ৫১টি অংশগ্রহণকারী দেশ অপরাধমূলকভাবে অর্জিত সম্পত্তি যেমন জমি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, যানবাহন এবং ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত তথ্য আদান-প্রদান ও অ্যাক্সেস করতে সক্ষম হবে। ইন্টারপোল এই বছরের জানুয়ারিতে ‘সিলভার নোটিশ’ চালু করেছে এবং এটি একটি পাইলট উদ্যোগের অংশ। এটি আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনের জন্য ইন্টারপোলের রঙিন নোটিশগুলির নতুন সংযোজন।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
সিবিআই-এর একজন মুখপাত্র বলেছেন, “এই ব্যবস্থা দুর্নীতি, আর্থিক জালিয়াতি, মাদক পাচার এবং পরিবেশগত অপরাধের মতো গুরুতর অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ চিহ্নিত ও খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।” এই নোটিশগুলি সীমান্ত পেরিয়ে অপরাধমূলক সম্পদ সনাক্তকরণ, চিহ্নিতকরণ এবং অবশেষে বাজেয়াপ্ত করার জন্য দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে সহজ করে তুলবে, যা দেশীয় আইন সাপেক্ষে কার্যকর হবে।
ইন্টারপোলের বিভিন্ন নোটিশ: একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা ইন্টারপোল বিভিন্ন ধরণের অপরাধ দমনের জন্য বিভিন্ন রঙের নোটিশ জারি করে, যার প্রত্যেকটির একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। ‘সিলভার নোটিশ’ এই ব্যবস্থার একটি নতুন সংযোজন। প্রচলিত কিছু নোটিশের মধ্যে রয়েছে:
- রেড নোটিশ (Red Notice): কোনো অপরাধীকে গ্রেফতার করে প্রত্যর্পণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রেফতারি পরোয়ানা।
- ব্লু নোটিশ (Blue Notice): একজন ব্যক্তি সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ বা তার অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য।
- গ্রিন নোটিশ (Green Notice): অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সতর্কতা, যারা ভবিষ্যতে অপরাধ করতে পারে।
- ইয়েলো নোটিশ (Yellow Notice): নিখোঁজ ব্যক্তিদের সনাক্তকরণে সহায়তা করার জন্য, বিশেষত নাবালক বা যারা নিজেদের সনাক্ত করতে অক্ষম।
- ব্ল্যাক নোটিশ (Black Notice): অজ্ঞাতনামা মৃতদেহ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।
- অরেঞ্জ নোটিশ (Orange Notice): কোনো ঘটনা, বস্তু বা প্রক্রিয়ার প্রতি গুরুতর এবং আসন্ন হুমকির বিষয়ে সতর্ক করা।
- পার্পল নোটিশ (Purple Notice): অপরাধীদের মোডাস অপারেন্ডি (অপরাধ করার পদ্ধতি), বস্তু, ডিভাইস এবং লুকানোর পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য চাওয়া।
‘সিলভার নোটিশ’ মূলত ব্লু নোটিশের একটি উন্নত রূপ, যা শুধুমাত্র ব্যক্তির অবস্থান নয়, তার অবৈধ সম্পদের বিস্তারিত তথ্য এবং তার উৎসও চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।
প্রথম ‘সিলভার নোটিশ’: শোকীন শুভমের ভিসা জালিয়াতি মামলায় ২৩ মে জারি করা প্রথম ‘সিলভার নোটিশটি’ শোকীন শুভম নামে এক প্রাক্তন অফিসারের বিরুদ্ধে। তিনি দিল্লির একটি বিদেশি দূতাবাসের ভিসা ও স্থানীয় আইন বিভাগে সংযুক্ত ছিলেন। সিবিআই-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের মে মাসের মধ্যে শুভম একটি ভিসা জালিয়াতির ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি অন্যদের সাথে মিলে অবৈধভাবে প্রতিটি আবেদনকারীর কাছ থেকে ১৫ লাখ থেকে ৪৫ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে শেনজেন ভিসা (Schengen visas) ইস্যু করেছেন।
তদন্তকারীরা অভিযোগ করেছেন যে শুভম দুবাইতে প্রায় ৭৭.৬ লাখ দিরহাম (প্রায় ১৫.৭৩ কোটি টাকা) মূল্যের ছয়টি সম্পত্তি কিনতে এই অবৈধ অর্থ ব্যবহার করেছেন। এর আগে তার অবস্থান এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য তার বিরুদ্ধে একটি ‘ব্লু নোটিশ’ জারি করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় ‘সিলভার নোটিশ’: অমিত লাখানপাল ও ক্রিপ্টো কেলেঙ্কারি ২৬ মে জারি করা দ্বিতীয় ‘সিলভার নোটিশটি’ অমিত মদনলাল লাখানপালের বিরুদ্ধে, যা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) দ্বারা পরিচালিত একটি মামলা। লাখানপালের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি নিয়ন্ত্রক অনুমোদন ছাড়াই ‘এমটিসি’ (MTC) নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু করে বিনিয়োগকারীদের ১১৩ কোটি টাকার বেশি প্রতারণা করেছেন।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনি বিশ্বাস অর্জনের জন্য নিজেকে অর্থ মন্ত্রকের প্রতিনিধি হিসেবে মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ আয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করেছিলেন। তিনি তহবিল ফেরত দিতে ব্যর্থ হন এবং ধারণা করা হচ্ছে যে সংগৃহীত অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
সম্পদ পুনরুদ্ধারে নতুন দিগন্ত
ভারতের আর্থিক প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি – যার মধ্যে সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এবং নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি) রয়েছে – এই নতুন ‘সিলভার নোটিশ’ বিভাগের অধীনে আরও কিছু মামলা বিবেচনার জন্য জমা দিয়েছে।
কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে এই উদ্যোগ আর্থিক অপরাধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে এবং বিদেশ থেকে দ্রুত সম্পদ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে। এই নোটিশগুলির অধীনে ভাগ করা তথ্য অবৈধ সম্পদ হিমায়িত করা, জব্দ করা বা বাজেয়াপ্ত করা সহ দ্বিপাক্ষিক আইনি পদক্ষেপের ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
‘সিলভার নোটিশ’ চালু হওয়াকে বৈশ্বিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য একটি বড় উন্নয়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা দেশগুলিকে সীমান্ত পেরিয়ে অপরাধমূলক সম্পদ খুঁজে বের করতে এবং পুনরুদ্ধারে একটি নতুন হাতিয়ার সরবরাহ করছে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা হচ্ছে।