Suvendu Adhikari Vidyasagar Univ

ব্যুরো নিউজ ১১ জুলাই ২০২৫ : বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের ইতিহাসের প্রশ্নপত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়ায় রাজ্যে আরেক বিতর্কের সুত্রপাত ঘটেছে। এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়াও, তিনি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে শোকজ এবং প্রশ্নপত্র প্রণেতাকে অবিলম্বে সাসপেন্ড করার দাবি তুলেছেন।

বিতর্কের সূত্রপাত

বুধবার বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ষষ্ঠ সেমিস্টারের ইতিহাসের পরীক্ষা ছিল। সেই প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্নে লেখা হয়, “মেদিনীপুরের তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নাম করো, যাঁরা সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হন?” এই প্রশ্নটি প্রকাশ্যে আসতেই শহিদ পরিবারের সদস্য, শিক্ষাবিদ ও সাধারণ মানুষ সহ বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘টেররিস্ট’ বা সন্ত্রাসবাদী বলত। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও একটি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রে একই ভাষা ব্যবহার করা হওয়ায় অনেকেই এটিকে নিন্দনীয় ও লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন।

Suvendu Adhikari : ‘ভাইপো গ্যাং’ টাকা তোলে, মুসলিম লিগের সরকার চলছে রাজ্যে – বিরোধী দলনেতার প্রকাশ্য তথ্য !

শুভেন্দু অধিকারীর আক্রমণ

বৃহস্পতিবার বিধানসভার বাইরে এক সাংবাদিক বৈঠকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুরের ইতিহাস সবার জানা। তিনজন অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেটকে যারা খুন করেছিলেন, তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, বেঙ্গল ভলান্টিয়ারের সদস্য ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিচ্ছে। কোয়েশ্চন সেটার কে ছিলেন সেটা জানা দরকার। অবিলম্বে তাঁকে সাসপেন্ড করতে হবে। ভিসি-কে শোকজ করতে হবে।” রাজ্যের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “উনি এখন ভৃত্য বসু হয়ে গিয়েছেন।”
শুভেন্দু অধিকারী মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান, মনে করিয়ে দেন যে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে অখিল গিরির মন্তব্যের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, “কারণ তিনিই শিক্ষা দফতরের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। ব্রাত্য বসুদের দেখা যায় না। কোশ্চেন সেটারের নামটা জানতে চায় বাংলা। তিনি কি টুকড়ে টুকড়ে গ্যাংয়ের লোক? তিনি কি মহম্মদ জিন্নার অবৈধ সন্তান? কোয়েশ্চন সেটার কে সেটা মাস্টারদা, নেতাজি, মাতঙ্গিনী হাজরার বাংলা জানতে চায়। আমরাও জানতে চাইছি তাঁর নাম কী?”

শহিদ পরিবার ও শিক্ষাবিদদের প্রতিক্রিয়া

স্বাধীনতা সংগ্রামী বিমল দাশগুপ্তের ছেলে রণজিৎ দাশগুপ্ত এই ঘটনায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “যাদের নাম ইতিহাসে লেখা, তাদের সম্পর্কে এমন শব্দপ্রয়োগ লজ্জার।” ‘শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চ’-এর সম্পাদক কিংকর অধিকারী মন্তব্য করেন, “বিষয়টি শুধুই ভুল নয়, এটি একটি নীতিগত বিপর্যয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত অবিলম্বে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া।”
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারও প্রশ্নপত্রের এই ভাষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “সন্ত্রাসবাদী শব্দটা সাম্রাজ্যবাদীরা ব্যবহার করত। যারা অহিংস আন্দোলন করত তাঁরাও ব্যবহার করত। কিন্তু, আমরা জানি দেশপ্রেমের ইতিহাসে তাঁরা কেউই সন্ত্রাসবাদী নন। তাঁরা প্রাণপন সংকল্প নিয়েছিলেন। মানে প্রাণ দেবেন বলেই প্রাণ নিতে দ্বিধা করতেন না। তাই তাঁদের সন্ত্রাসবাদী বলা মানে আমরা সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাকে ভুলতে পারিনি। আর মেদিনীপুরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রশ্ন করা খুবই লজ্জার। কারণ, মেদিনীপুর অসংখ্য বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছে। তাঁদের জন্য আমরা গর্বিত। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মেদিনীপুরের একটা আলাদা স্থান আছে।” তিনি আরও বিস্ময় প্রকাশ করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র পরীক্ষা করার জন্য একটি কমিটি থাকা সত্ত্বেও কেন এই ধরনের ভুল চোখে পড়ল না।

Suvendu vs Mamata : পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবিতে রাজনৈতিক বিতর্ক !

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৯৩১ সালের ৭ এপ্রিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডিকে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে গুলি ছুড়ে হত্যা করেন বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্তজ্যোতিজীবন ঘোষ। এরপর ১৯৩২ সালের ৩০ এপ্রিল ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট ডগলাসকে জেলা বোর্ডের অফিসে ঢুকে হত্যা করেন বিপ্লবী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যপ্রভাংশুশেখর পাল। পরের বছর ১৯৩৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বার্নাড ই জে বার্জকে হত্যা করেন বিপ্লবী অনাথবন্ধু পাঁজা, মৃগেন দত্ত, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়নির্মলজীবন ঘোষ। এই বিপ্লবীরা দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন এবং তাঁরা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর সদস্য ছিলেন।

বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে পার্থক্য

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপ্লবী এবং সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বিপ্লবী তারাই হন যারা নিঃস্বার্থে কোনো এক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। বিপ্লবীদের লক্ষ্য বা শত্রু হয় কোনো এক অত্যাচারী সরকার এবং তার প্রশাসন, দলদাস এবং বাহিনী। অন্যদিকে, সন্ত্রাসবাদীর উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি, সন্ত্রাস এবং আতঙ্ক ছড়ানো। সন্ত্রাসবাদীরা সর্বদা সাধারণ মানুষের ওপর হত্যা-নির্যাতন করে প্রচারে আসতে চায় এবং কোনো এক সমাজ ব্যবস্থাকে আতঙ্কের জিম্মি বানিয়ে নিজেদের নেতিবাচক উদ্দেশ্য পূরণ করতে চায়। বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়া কেবল স্বৈরাচারী এবং সমাজবিরোধী মানসিকতার প্রতিফলন, শিক্ষাবিদদের নয়। এই দুটি শব্দের বানান এবং মানেতে যথেষ্ট পার্থক্য আছে, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কোনোও ভুল-ত্রুটি নয়।
তবে যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ইতিহাস বিকৃত করার প্রবণতা টের পাওয়া যায় , সে অভিনেতা রাকেশ রোশনের চন্দ্র ভ্রমণ হোক বা কাজি নজরুলের মহাভারত রচনা – সেই রাজ্যের বিস্ববিদ্যালয় থেকে আর কি প্রত্যাশা করা যায় ?  ক্ষমা দাবি করলেও , মানসিক ভাবে অভিযুক্ত ক্ষমাপ্রার্থী নয় । এইটা গোটা বাঙালি সমাজের লজ্জা !

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর