শুদ্ধাত্মা মুখার্জি, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : ভারতের দ্রুত জ্বালানি রূপান্তর কর্মসূচির আওতায় পেট্রোলের সাথে ২০% ইথানল মিশ্রণ (E20) পরিবেশ দূষণ কমাতে ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু এই নীতির দ্রুত বাস্তবায়ন ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য অভিযোগ জমা হচ্ছে যে, E20 জ্বালানি ব্যবহারে গাড়ির জ্বালানী সাশ্রয় (মাইলেজ) কমছে এবং পুরোনো ইঞ্জিনের ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে যেখানে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি সাশ্রয় এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর কথা বলা হচ্ছে, সেখানে চালকেরা এই মিশ্রণের কারণে তাঁদের গাড়ি এবং পকেট— দুইয়েরই ক্ষতির কথা বলছেন।
কেন ইথানল বিতর্কিত?
সরকারের মতে, ভারত নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর আগেই এই বছরের মার্চ মাসে দেশের অনেক অঞ্চলে ২০% ইথানল মিশ্রণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। এটি এক দশকেরও বেশি সময়ে ইথানল মিশ্রণের পরিমাণ ১৩ গুণেরও বেশি বাড়িয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এতে ১.০৬ ট্রিলিয়ন রুপি (প্রায় ১২.০৯ বিলিয়ন ডলার) সাশ্রয় হয়েছে এবং ৫৪.৪ মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
তবে এই সাফল্যের সঙ্গে কিছু সমস্যাও যুক্ত। ইথানল উৎপাদনে আখ, ভুট্টা এবং চালের মতো খাদ্যশস্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যা খাদ্য ও পশুখাদ্যের প্রাপ্যতায় ঘাটতি তৈরি করছে। অতিরিক্ত ইথানল উৎপাদন করতে গিয়ে এই ফসলগুলো এখন খাদ্যশস্যের পরিবর্তে অর্থকরী ফসল হিসেবে বিক্রি হচ্ছে, যার ফলে দেশের চাহিদা মেটাতে উল্টো খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ফসল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে যে পরিমাণ কার্বন নির্গত হয়, তা অনেক সময় জ্বালানি সাশ্রয় থেকে প্রাপ্ত সবুজ সুবিধার চেয়ে বেশি হতে পারে। এছাড়াও, আখ-এর মতো ফসলে বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার হয়, যা পানীয় জল এবং কৃষিকাজের জন্য জল সংকটের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
চালকদের অসন্তোষের কারণ
২০২৩ সালের মার্চ মাসের আগে বিক্রি হওয়া লক্ষ লক্ষ গাড়ি এবং মোটরসাইকেল শুধুমাত্র ৫% বা ১০% ইথানল মিশ্রিত জ্বালানির জন্য উপযুক্ত। চালকদের অভিযোগ, তাঁদেরকে জোর করে উচ্চ মিশ্রণের জ্বালানি ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁরা কম মাইলেজ এবং ইঞ্জিন সম্পর্কিত সমস্যা যেমন— অস্বাভাবিক শব্দ, ইঞ্জিন চালু হতে সমস্যা এবং ফিল্টার জ্যাম হওয়ার কথা বলছেন। গত সপ্তাহে একটি বীমা কোম্পানির ঘোষণার পর এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে, যেখানে বলা হয় ভুল জ্বালানি ব্যবহারের কারণে ইঞ্জিনের ক্ষতি হলে বীমার আওতায় তা থাকবে না।
এ বিষয়ে ভারতীয় পেট্রোল গ্রাহকেরা ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ তুলে ধরে পুরোনো গাড়ির জন্য কম ইথানল মিশ্রিত জ্বালানি কেনার বিকল্পের দাবি জানিয়েছেন। যদিও সরকার বা বিভিন্ন গাড়ি নির্মাতা সংস্থা বর্তমানে আশ্বস্ত করছে যে E20 জ্বালানি ব্যবহার করলে ওয়ারেন্টি বা বীমার কোনো সমস্যা হবে না, তবে এই বিষয়ে এখনও বিস্তারিত এবং স্বাধীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্য জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয়নি।
সরকারের বক্তব্য ও বিশেষজ্ঞদের মত
অনলাইনে E20 সম্পর্কিত অভিযোগের পর কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রী এই অভিযোগগুলোকে ‘পেট্রো-লবি’র ভয় দেখানো হিসেবে অভিহিত করেছেন। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকও বলেছে যে E20 জ্বালানি ব্যবহারে বীমার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় বড় ধরনের ইঞ্জিনের ক্ষতি বা কার্যকারিতার হ্রাস দেখা যায়নি। তবে মন্ত্রক স্বীকার করেছে যে নতুন গাড়িতে ১% থেকে ২% এবং পুরোনো গাড়িতে ৬% পর্যন্ত মাইলেজ কমতে পারে।
অটোমোটিভ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (ARAI)-এর প্রধান রেজি মাথাই এই বিষয়ে বলেন, “E20 ভারতের রাস্তায় চলা যেকোনো গাড়ির জন্য নিরাপদ।” তিনি জানান, একটি সমীক্ষায় ২-৩টি গাড়ির ব্র্যান্ডের ২-৩টি মডেলের দুই চাকার এবং চার চাকার গাড়ি ১ লক্ষ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে পরীক্ষা করা হয়েছে, যেখানে E20 জ্বালানির কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া যায়নি। সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স-এর নির্বাহী পরিচালক প্রশান্ত ব্যানার্জি আরও জানান যে গাড়ি প্রস্তুতকারক এবং বীমা প্রদানকারী সংস্থাগুলি এই বিষয়ে গ্রাহকদের কাছে লিখিতভাবে আশ্বস্ত করবে।
সম্ভাব্য সমাধান ও কারিগরি দিক:
এই পরিস্থিতিতে, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কমাতে ও জ্বালানি রূপান্তরকে মসৃণ করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। কারিগরি সমাধানগুলো হলো:
- E20 রূপান্তর কিট: সকল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য E20 রূপান্তর কিট তৈরি করা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এই কিটে নিম্নলিখিত অংশগুলি পরিবর্তন করা হবে:
- ফুয়েল লাইন এবং পাইপ (কার্বুরেটর এবং ফুয়েল ট্যাঙ্ক থেকে)।
- ইথানল ব্যবহারের জন্য ইগনিশন প্যারামিটার পরিবর্তন করা, অর্থাৎ CDI বা ECU কোডিং-এ পরিবর্তন আনা।
- ফুয়েল সরবরাহকারী যন্ত্রাংশের এবং ফুয়েল ট্যাঙ্কের গ্যাকেট, অয়েল সিলগুলি ইথানল মিশ্রিত জ্বালানির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যক।
- শক্তি দক্ষতা বৃদ্ধি: জ্বালানি গবেষণাগারগুলোকে মিশ্রিত জ্বালানির অকটেন মান বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
- মূল্য হ্রাসের বিকল্প: এই সমস্ত কারিগরি সমাধানের পরিবর্তে, পেট্রোলকে GST-র অধীনে এনে এর দাম কমানো যেতে পারে। বর্তমানে জ্বালানীতে বহু ধরনের সেস এবং করের কারণে পেট্রোলের দাম বেশি, যা GST-তে আনলে প্রতি লিটারে দাম ৬০-৬৫ টাকা পর্যন্ত নেমে আসতে পারে। এতে মানুষ যেমন খুশি হয়ে তাঁদের গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করবে, তেমনই ১৯৪০ এবং ২০০০-এর দশকের দুই স্ট্রোক গাড়ির যুগে সীসামুক্ত জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহিত হয়েছিল।
ইথানল উৎপাদন পদ্ধতি পরিবর্তন:
বর্তমানে আখ, ভুট্টা এবং চাল থেকে সরাসরি ইথানল উৎপাদন করা হচ্ছে, যার ফলে খাদ্যশস্যের বাজারে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যদি জৈব বর্জ্য (biowaste) থেকে ইথানল প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, তবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। সরকার প্রথমে ভেবেছিল যে বর্জিত বা অত্যাধিক খাদ্যশস্য দিয়ে এই চাহিদা মেটানো সম্ভব, কিন্তু তা যথেষ্ট হয়ে ওঠেনি ।
Putin : মার্কিন শুল্ক সত্ত্বেও ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক অবিচল, প্রশংসায় মস্কো।
ভবিষ্যতের পথ:
সরকারের উচিত আরও সময় এবং পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা। একই সাথে একাধিক মিশ্রিত জ্বালানি বিকল্পের ব্যবস্থা করা হলে জনগণের অসন্তোষ হ্রাস পেতে পারে। কারণ এতে গাড়ি নির্মাতারা E20 কিট তৈরি এবং রোলআউটের জন্য সময় পাবে। বর্তমান সময়ে জ্বালানির দাম না কমানো এবং ১৫ বছরের পুরনো গাড়িগুলিকে পুনঃ-নিবন্ধন না করার মতো পদক্ষেপ গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট করতে পারে। বিশেষভাবে যখন গাড়ি ব্যবহার ‘Gen Z’ জেনজি প্রজন্মের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তখন সরকারের উচিত এই বিষয়টিকে আরও বিচক্ষণতার সাথে মোকাবিলা করা।