ব্যুরো নিউজ ১৩ আগস্ট ২০২৫ : দিল্লি-এনসিআর থেকে সব পথকুকুর সরিয়ে নেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর দেশজুড়ে তীব্র আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এবং বিভিন্ন পশু অধিকার কর্মীরা আদালতের এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে, অনেক আবাসন সমিতি এবং সাধারণ মানুষ এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি আর মহাদেবনের একটি বেঞ্চ এই নির্দেশ জারি করে।
রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর তীব্র প্রতিক্রিয়া
বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এক্স (পূর্বের টুইটার)-এ এই নির্দেশকে “কঠোর ও দূরদৃষ্টিহীন” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “এই নির্বাক প্রাণীরা কোনো সমস্যা নয় যাকে মুছে ফেলা হবে। আশ্রয় কেন্দ্র, বন্ধ্যাকরণ, টিকাকরণ এবং কমিউনিটি কেয়ারের মাধ্যমে নির্মমতা ছাড়াই রাস্তা নিরাপদ রাখা যায়।” একই সুরে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও এই নির্দেশের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, “হঠাৎ করে সব কুকুরকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত অমানবিক হবে।” তিনি আরও বলেন, “শহুরে পরিবেশে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাব রয়েছে এবং অনেক সময় প্রাণীরা নির্যাতনের শিকার হয়।”
মুম্বইয়ের বহুতল আবাসনের ১৭ তলা থেকে পথ কুকুরের ঝাঁপ, অভিযুক্ত আবাসনের নিরাপত্তাকর্মী
জননিরাপত্তা ও মানবিকতার বিতর্ক
সুপ্রিম কোর্ট তার নির্দেশে পথকুকুরের ক্রমবর্ধমান কামড় ও জলাতঙ্কের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। একটি ছয় বছরের শিশুর জলাতঙ্কে মৃত্যুর খবরকে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করে আদালত। আদালত দিল্লিকে ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৫,০০০ কুকুরের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় ধারণক্ষমতা বাড়ানোর কথাও বলেছে। নয়ডা, গুরুগ্রাম এবং গাজিয়াবাদের কর্তৃপক্ষকেও এই নির্দেশ মেনে চলতে বলা হয়েছে। আদালত জানিয়েছে, জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা এই প্রক্রিয়ায় বাধা দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা এই নির্দেশের পক্ষে বলেন, “আমরা কিছু কুকুরপ্রেমীর জন্য আমাদের শিশুদের জীবন বলি দিতে পারি না।”
তবে, এই রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা উঠে এসেছে। অভিনেতা জন আব্রাহাম প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে এই নির্দেশ পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এরা ‘বিপথগামী’ নয়, বরং সম্প্রদায়ের কুকুর, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করছে।” পশু অধিকার কর্মী মানেকা গান্ধী এই সিদ্ধান্তকে “অবাস্তব” এবং “অকার্যকর” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, দিল্লির ৩ লক্ষ কুকুরের জন্য ৩,০০০ আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করতে ১৫,০০০ কোটি টাকা খরচ হবে, যা অবাস্তব।
সমাজের দ্বিমুখী আবেগ ও মানবিকতার অভাব
এই ঘটনার মধ্যে মানবিকতার অভাব এবং সমাজের দ্বিমুখী চরিত্রের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। যখন কোনো কুকুরপ্রেমী রাস্তার কুকুরকে খাবার দেয়, তখন তাদের প্রশংসা করা হয়, কিন্তু যখন একই কুকুর দুর্ঘটনার শিকার হয় বা তাদের মধ্যে মারামারি হয়, তখন সেই মানবিকতা উধাও হয়ে যায়। তথাকথিত কুকুরপ্রেমীরা ধর্মীয় আচারে পশু বলির সময় নীরব থাকেন, কিন্তু যখন পশু সুরক্ষার জন্য একটি পরিবেশ তৈরির প্রয়োজন হয়, তখন তাদের উদ্বেগ প্রকাশ্যে আসে।
রাস্তার কুকুররা যতক্ষণ আশ্রয়কেন্দ্রে সুরক্ষিত না থাকে বা মানুষের বসতির রাস্তায় অসুরক্ষিত থাকে, ততক্ষণ তাদের ওপর নিকৃষ্টতম পশু নির্যাতন করা হয়। কখনও কখনও মানুষের নিরাপত্তা এড়াতে কুকুর লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, কখনও আবার রাস্তার কুকুরছানাদের ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ির নিচে চাপা দিয়ে বা পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় আশ্রয়কেন্দ্রের কুকুরদের নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, শুধুমাত্র এই কারণে যে ওই আশ্রয়কেন্দ্রের মালিক বিরোধী দলের হয়ে প্রচার করেছিলেন। এই সমস্ত ঘটনা মানুষের ভণ্ডামি এবং নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত উদাহরণ। মানুষের এই ধরনের আচরণ প্রমাণ করে যে, সমাজে প্রাণীদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈষম্য রয়েছে।
কলকাতার নিউটাউনে খাবারে বিষ মিশিয়ে পথকুকুরদের হত্যাচেষ্টা
আদালতের পক্ষ থেকে আশ্বাস
এসব জটিলতার মুখে প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাই একজন আইনজীবীর উদ্বেগ শোনার পর এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। ওই আইনজীবী বলেন, এর আগে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে বলা হয়েছিল যে, পথকুকুরদের নির্বিচারে হত্যা করা যাবে না। প্রধান বিচারপতির এই আশ্বাস কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে, তবে এই বিতর্কের সমাধান এখনো অনিশ্চিত।