ব্যুরো নিউজ ২৬ মে : বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, বর্তমানে বহুমুখী সংকটের মুখে। নাগরিক সমাজ এবং ব্যবসায়ী মহল সরকারের নীতিতে অসন্তুষ্ট, যার ফলস্বরূপ দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। রাজধানী ঢাকার রাজপথে অসন্তোষের আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে, এবং প্রশাসন চরম নৈরাজ্যের আশঙ্কা করছে।
ব্যবসায়ী মহলের উদ্বেগ: “১৯৭১-এর মতো ব্যবসায়ীরাও নিহত হচ্ছেন”
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলির যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, “১৯৭১ সালে যেমন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, এবার ব্যবসায়ীদের হত্যা করা হচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ বেকার।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা জানি না, ঈদুল আজহার আগে শ্রমিকদের বোনাস ও বেতন দিতে পারব কিনা।” গত আট মাসে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটিও বিনিয়োগকারী আনতে ব্যর্থ হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে অনাগ্রহী, কারণ তারা ভিয়েতনামকে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি লাভজনক মনে করছেন।
সরকারি কর্মীদের ধর্মঘট: নতুন আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ
প্রস্তাবিত ‘পাবলিক সার্ভিস (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর বিরুদ্ধে টানা দুদিন ধরে বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে সরকারি কর্মচারীরা বিক্ষোভ করছেন। এই প্রস্তাবিত আইন প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা। কর্মচারীদের মতে, এই আইন কার্যকর হলে যেকোনো সময় প্রশাসন সরকারি কর্মচারীদের কঠোর শাস্তি এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবে, যা তাদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গত সপ্তাহে এই অধ্যাদেশটি অনুমোদন করেছে এবং এটি এখন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, রাজস্ব সংস্কার উপদেষ্টা কমিটি এবং অন্যান্য প্রধান অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা না করে এই আইন বাস্তবায়ন করা হবে না।
রাজস্ব বোর্ড এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘট: অচলাবস্থার দিকে দেশ
গত দুদিন ধরে চুক্তিবদ্ধ কর্মীরাও কর্মবিরতি পালন করছেন। রাজস্ব নীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ সংশোধনের দাবিতে স্টেট বোর্ড অফ রেভিনিউ (NBR)-এর কর্মীরাও প্রতিবাদে নেমেছেন। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে NBR ভেঙে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। NBR কর্মীদের ধর্মঘটের ফলে প্রতিদিন প্রায় ১২২-১৬৩ মিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বন্ধের হুমকি দিয়েছেন। তাদের তিনটি মূল দাবি রয়েছে, যার মধ্যে প্রধান হলো, তাদের বেতন গ্রেড ১১ অনুযায়ী নির্ধারণ করা। শিক্ষকরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের দাবি পূরণ না হলে তারা কাজ করবেন না।
ইউনূস সরকারের ওপর চারদিক থেকে চাপ: ‘গৃহযুদ্ধের’ মতো পরিস্থিতি
ফলাফলস্বরূপ, ইউনূস সরকার চারদিক থেকে চাপের মুখে পড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন যে, বর্তমানে বাংলাদেশে ‘গৃহযুদ্ধের’ মতো পরিস্থিতি চলছে। প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম, ইউনূসের বক্তব্য উল্লেখ করে বলেছেন, “দেশের ভেতরে এবং বাইরে একটি যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা সামনে এগোতে পারছি না। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে এবং দেশকে দাসত্বের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করার পর থেকেই দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই অবক্ষয় থেকে আমাদের নিজেদের বাঁচাতে হবে।”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি গত ১০ মে অ্যান্টি-টেররিজম আইনের অধীনে নেওয়া হয়েছিল এবং এর ফলে দলটির সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম, সভা-সমাবেশ, প্রকাশনা, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই পদক্ষেপকে মৌলিক স্বাধীনতার ওপর অতিরিক্ত বিধিনিষেধ আরোপ বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা
মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের জন্য আরও ছয় মাস সময় চেয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, এই বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রাথমিকভাবে তিনি ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেও, ইউনূস এখন স্পষ্ট করেছেন যে, আগামী বছরের ৩০ জুনের পর তিনি আর পদে থাকবেন না এবং তার আগেই বাংলাদেশে নির্বাচন সম্পন্ন হবে।
তবে, সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে দেখা করে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের উপর জোর দিয়েছেন। তারা একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করুক বলে মনে করেন। পাশাপাশি, সামরিক বাহিনী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর তৈরির প্রস্তাব নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। সামরিক প্রধান বলেছেন যে, সরকারের বিভিন্ন কৌশলগত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সামরিক বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা সত্ত্বেও তাদের অন্ধকারে রাখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে বলেছেন যে, রাজনৈতিক দল ও জনগণকে অন্ধকারে রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো পরিকল্পনা কার্যকর হবে না। তিনি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনকালীন একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ এবং সংস্কারের দাবি তুলেছে।
পশ্চিমবঙ্গেও একই পরিস্থিতি: বকেয়া DA ও চাকরি দুর্নীতির জেরে ক্ষোভ
উল্লেখ্য, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রায় একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গেও। বকেয়া মহার্ঘ ভাতা (DA) এবং ব্যাপক চাকরি দুর্নীতির কারণে চাকরি হারানো বহু সরকারি কর্মী ও শিক্ষক লাগাতার আন্দোলন করছেন। এই আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আইন অমান্য কর্মসূচিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
বকেয়া ডিএ নিয়ে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের আইনি লড়াই চলছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তিন মাসের মধ্যে ২৫% বকেয়া মহার্ঘ ভাতা পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের সঙ্গে ডিএ-র সমতা আনার চলমান আইনি বিবাদের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সিদ্ধান্ত। যদিও রাজ্য সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল, তবুও আদালতের নির্দেশ রাজ্যের কর্মচারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ সহ বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন এই বকেয়া ডিএর দাবিতে লাগাতার ধরনা, বিক্ষোভ এবং আইন অমান্য আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় কর্মীদের তুলনায় রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ-র ফারাক প্রায় ৩৯ শতাংশ।
পাশাপাশি, স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়েছে। এই চাকরিহারাদের একাংশ নিজেদের ‘যোগ্য’ দাবি করে চাকরির দাবিতে আন্দোলন করছেন। অন্যদিকে, ‘অযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিতদের একাংশকেও রাজ্য সরকার ভাতা দেওয়ার ঘোষণা করেছে, যা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক ও মামলা দায়ের হয়েছে হাইকোর্টে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীরা এবং শিক্ষকরা উভয়ই সরকারের বিরুদ্ধে বঞ্চনা ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আন্দোলনের পথ বেছে নিচ্ছেন, যা সামগ্রিকভাবে রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অচলাবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে।