ব্যুরো নিউজ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোর জাভারি মন্দিরে একটি ক্ষতিগ্রস্ত বিষ্ণুমূর্তি পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত একটি আবেদনের শুনানি চলাকালীন ভারতের প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাইয়ের একটি মন্তব্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বহু ব্যবহারকারী তার এই মন্তব্যকে ‘অসংবেদনশীল’ বলে অভিহিত করেছেন।
এনডিটিভি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট খোজুরাহোর এই মন্দিরে বিষ্ণুমূর্তির মস্তকবিহীন প্রতিমাটি পুনরুদ্ধারের আবেদন শুনতে অস্বীকার করে জানায় যে, বিষয়টি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (ASI)-এর আওতাধীন। প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাই এবং বিচারপতি অগাস্টিন জর্জ মাসিহ-এর সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ, ইউনেস্কো-র তালিকাভুক্ত এই মন্দিরের ৭ ফুট উঁচু মূর্তিটি মেরামতের জন্য করা আবেদনের শুনানি করছিল।
প্রধান বিচারপতির মন্তব্য
এনডিটিভি-র প্রতিবেদন অনুসারে, প্রধান বিচারপতি গাভাই আবেদনকারীকে বলেন, “আপনি নিজেই গিয়ে দেবতাকে কিছু করতে বলুন। আপনি তো বলেন যে আপনি ভগবান বিষ্ণুর একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। তাহলে এখন গিয়ে প্রার্থনা করুন। এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং এএসআই-এর অনুমতি দরকার। দুঃখিত।”
রাকেশ দালাল নামক একজন ব্যক্তি এই আবেদনটি করেন। তার দাবি, মুঘল আক্রমণের সময় মূর্তিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং কর্তৃপক্ষকে বহুবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এর পুনরুদ্ধার করা হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই মন্দিরগুলি চান্দ্রবংশী রাজাদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সময় দীর্ঘ অবহেলার পর স্বাধীনতা লাভের পরেও সরকারি উদাসীনতায় মূর্তিটি বিকৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
আবেদনকারী আরও অভিযোগ করেন যে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা ভক্তদের উপাসনার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে। তিনি জানান যে, প্রতিমাটি পুনরুদ্ধারের দাবিতে একাধিক প্রতিবাদ, স্মারকলিপি এবং প্রচার চালানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
বিচারপতির মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক
এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাডভোকেট বিনীত জিন্দাল ভারতের প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাইকে তার মন্তব্য প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এক্স প্ল্যাটফর্মে তার আবেদন শেয়ার করে জিন্দাল লিখেছেন, “একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে আমি ভারতের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বিচারপতি বি আর গাভাইকে একটি চিঠি পাঠিয়েছি, যেখানে আমি ভগবান বিষ্ণু এবং হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত করার জন্য তার মন্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছি।”
অনেক সমালোচক মনে করছেন, ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে এ ধরনের বিবেক-বিবেচনাহীন মন্তব্য অপ্রত্যাশিত। তাদের যুক্তি হলো, যদি বিচারপতির যুক্তি মেনে চলতে হয়, তবে আফগানিস্তানের বামিয়ানে তালিবান জঙ্গিদের হাতে ধ্বংস হওয়া গৌতম বুদ্ধের মূর্তি কেন নিজে থেকেই নিজেকে রক্ষা করতে পারল না, তার জবাব কি তিনি দিতে পারবেন? মূর্তি মানুষের আস্থার প্রতীক কোনও জলজ্যান্ত দৈব নয় , সেই আস্থা রক্ষা করার দায়িত্ব মানুষের । যে মানুষ ঐতিহ্য , সৃষ্টি কলা , ভাস্কর্য রক্ষা করতে সক্ষম নয় , তার দৈব এক্তিয়ার সম্বন্ধে টিপ্পনী করাও উচিৎ নয় ।
বিচার ব্যবস্থা এবং সংবিধানের প্রতি প্রশ্ন
অনেকেই সুপ্রিম কোর্টের বিচার ব্যবস্থাকে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন। তারা বলেন, সুপ্রিম কোর্ট যখন সংবিধানের অভিভাবক, তখন পশ্চিমবঙ্গে যোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিল হল কেন ? যারা দুর্নীতিগ্রস্ত, তারা জামিন পেল কেন ? সংবিধান কি বলেছে দুর্নীতিগ্রস্তদের মুক্ত করে দেওয়া হোক ? যদি ঈশ্বর তার নিজের প্রতিমা ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারে উদাসীন হন, তাহলে বলা যায় যে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতও প্রকৃত বিচার প্রদানে উদাসীন । ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ, কিন্তু এর মানে এই নয় যে তার প্রধান অভিভাবক ভারতে নাস্তিকতার প্রচার করবেন সংবিধানের দোহাই দিয়ে—এটি অসাংবিধানিক।
আদালতের আসনে বসে একজন বিচারপতির ব্যক্তিগত মতামত ও কটাক্ষ গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এই ধরনের মন্তব্যের জন্য ভারতের সমস্ত আস্তিক নাগরিকের কাছে তার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত বলে মনে করেন অনেকে। এর ফলে সর্বোচ্চ আদালত সম্পর্কে এই বার্তা যাচ্ছে যে, এটি জনভাবাবেগের প্রতি ‘অসংবেদনশীল’ এবং প্রকৃত বিচারের পরিবর্তে মতবাদ প্রচার বা খণ্ডনের স্থানে পরিণত হয়েছে। আইন অন্ধভাবে বিচার করে, সংবিধান ছাড়া আর কিছু বোঝে না। তাই আইনের প্রেরকদের সাংবিধানিকভাবে ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রসিক মন্তব্য শোভা পায় না।