ব্যুরো নিউজ ১৮ জুলাই ২০২৫ : “এই জ্ঞান সমস্ত শিক্ষার রাজা, সমস্ত গোপনীয়তার মধ্যে সবচেয়ে গোপনীয়। এটি বিশুদ্ধতম জ্ঞান, এবং এটি উপলব্ধির মাধ্যমে আত্মার প্রত্যক্ষ জ্ঞান দান করে, তাই এটি ধর্মের পূর্ণতা।” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৯.২
সনাতন ধর্ম, মহাবিশ্বের শাশ্বত বিধান, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মাধ্যমে তার গভীরতম অভিব্যক্তি খুঁজে পায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে এই আধ্যাত্মিক কথোপকথন মানব বিবর্তনের একটি সম্পূর্ণ নীলনকশা প্রদান করে, যা ধর্ম, আত্মার প্রকৃতি, কর্মের শক্তি, ভক্তির পথ এবং মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্যকে উন্মোচন করে।
১. আত্মা: শাশ্বত সত্তা
সনাতন ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আত্মার উপলব্ধি, যা চিরন্তন সত্তা। গীতায় আত্মাকে অপরিবর্তনীয়, অবিনশ্বর এবং চিরবিদ্যমান হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ম ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২.২০
অর্থ: আত্মা কখনও জন্মায় না বা মারা যায় না। এটি যখন শরীর ধ্বংস হয়, তখন ধ্বংস হয় না। এটি জন্মহীন, নিত্য, চিরস্থায়ী এবং আদি।
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ব্যাখ্যা করেছেন যে মৃত্যুর জন্য শোক করা অনুচিত, কারণ আত্মা কখনও মরে না। এই উপলব্ধি আধ্যাত্মিক জীবনের মূল গঠন করে। যিনি আত্মাকে উপলব্ধি করেন, তিনি জানেন যে তিনি শরীর বা মন কোনটিই নন, বরং আরও গভীর কিছু — সমস্ত পরিবর্তনের সাক্ষী, যিনি সময় দ্বারা অস্পৃশ্য। আত্মা কর্ম দ্বারা কখনও কলঙ্কিত হয় না, এবং জন্ম-মৃত্যুর ভার বহন করে না। এই শাশ্বত পরিচয় উপলব্ধির মাধ্যমে নির্ভীকতা, স্পষ্টতা এবং শান্তি আসে।
সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ
২. কর্ম: ধার্মিক কর্মের পথ
কর্ম শুধু কাজ করা নয়, বরং সঠিকভাবে কাজ করা — ধর্মের (নৈতিক ও মহাজাগতিক বিধান) সাথে সঙ্গতি রেখে। শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগকে, অর্থাৎ নিঃস্বার্থ কর্মের পথকে, মুক্তির উপায় হিসাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি॥” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২.৪৭
অর্থ: তোমার কর্তব্য কর্ম সম্পাদনের অধিকার আছে, কিন্তু তুমি কর্মফলের অধিকারী নও। কর্মফলের হেতু হয়ো না এবং কর্মত্যাগেও আসক্ত হয়ো না।
এটি গীতার অন্যতম বহুল উদ্ধৃত শ্লোক, যা ফলের প্রতি অনাসক্তি শেখায়। যখন কেউ স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই কর্তব্য থেকে কাজ করে, তখন কর্ম শুদ্ধ হয়। এই ধরনের কর্ম আত্মাকে আবদ্ধ করে না বা নতুন কর্ম উৎপন্ন করে না। সনাতন ধর্মে, কর্ম শাস্তি নয়, বরং ভারসাম্যের একটি বিধান। প্রতিটি চিন্তা, শব্দ এবং কাজের ফলাফল রয়েছে — যা বাহ্যিকভাবে আরোপিত নয়, বরং অভ্যন্তরীণভাবে উৎপন্ন।
শ্রীকৃষ্ণ শিক্ষা দেন যে নিজের ধর্ম (যদিও অসম্পূর্ণভাবে) পালন করা অন্যের কর্তব্য নিখুঁতভাবে পালনের চেয়েও উত্তম।
“শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাত্ স্বনুষ্ঠিতাৎ।” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৩.৩৫
ধার্মিক কর্ম, সমাজের নিজের ভূমিকা এবং জীবনের পর্যায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সম্পাদিত হলে আত্মাকে শুদ্ধ করে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়।
৩. ভক্তি: ভক্তির শক্তি
জ্ঞান ও কর্ম অপরিহার্য হলেও, গীতা ভক্তিকে (পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি) সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও শক্তিশালী পথ হিসাবে তুলে ধরেছে। এর শেষ অধ্যায়গুলিতে শ্রীকৃষ্ণ ঘোষণা করেন যে যারা অবিভক্ত প্রেম নিয়ে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে, তারা পরম লক্ষ্য অর্জন করে।
“মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু। মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োঽসি মে॥” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮.৬৫
অর্থ: আমাতে মন রাখো, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা করো এবং আমাকে প্রণাম করো। তুমি নিশ্চিতভাবে আমার কাছে আসবে — আমি তোমাকে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি কারণ তুমি আমার প্রিয়।
শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা বা মতবাদের বিপরীতে, ভক্তি হৃদয় থেকে উদ্ভূত হয় — দিব্যত্বের সাথে একটি মানসিক সংযোগ। ভক্তি হল আকাঙ্ক্ষার আগুন, আত্মসমর্পণের গান এবং প্রেমের আলো যা অহংকে পুড়িয়ে ফেলে। জপ, প্রার্থনা, সেবা বা স্মরণের মাধ্যমে — ভক্তি সাধককে রূপান্তরিত করে। শ্রীকৃষ্ণ এমনকি মহাপাপীদেরও আশ্বাস দেন যে যদি তারা ভক্তিসহকারে তাঁর দিকে ফিরে আসে, তবে তারা উদ্ধার পাবে।
“অপি চেত্ সুদুরাচারো ভজতে মাম্ অনন্যাভাক্। সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ব্যবসিতো হি সঃ॥” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৯.৩০
ভক্তি গর্ব ও অহংকে দ্রবীভূত করে এবং সর্বোচ্চ আনন্দের দিকে নিয়ে যায় — পরমাত্মার সাথে মিলন।
৪. জ্ঞান: মুক্তির জ্ঞান
গীতায় প্রকৃত জ্ঞান (জ্ঞান) একাডেমিক নয়, বরং অস্তিত্বগত — আত্ম এবং পরমাত্মার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। এই জ্ঞানই মায়াকে ছিন্ন করে এবং আত্মাকে মুক্ত করে।
“তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া। উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ॥” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪.৩৪
অর্থ: বিনীতভাবে, আন্তরিক অনুসন্ধিৎসু হয়ে এবং সেবা করে একজন উপলব্ধ শিক্ষকের কাছে যাও। আত্ম-উপলব্ধিকারীরা তোমাকে জ্ঞান দান করতে পারেন, কারণ তারা সত্য দেখেছেন।
গীতায়, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শরীর (ক্ষেত্র) এবং শরীরের জ্ঞাতা (ক্ষেত্রজ্ঞ) এর মধ্যে পার্থক্য শেখান। প্রকৃতি (প্রকৃতি) এবং পুরুষ (আত্মা) এর মধ্যে পার্থক্য জানা প্রকৃত জ্ঞানের সূচনা।
“ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োর্জ্ঞানং যত্তজ জ্ঞানং মতং মম।” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩.৩
এই জ্ঞান প্রকাশ করে যে সমস্ত প্রাণী একই ঐশ্বরিক সত্তার অভিব্যক্তি। অজ্ঞতা আবদ্ধ করে, জ্ঞান মুক্ত করে। এটি ভয় দূর করে, আসক্তি দূর করে এবং মুক্তির দ্বার খুলে দেয়।
Brahma ; সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সীমিত উপাসনা: এক বিস্ময়কর রহস্য !
৫. মোক্ষ: চূড়ান্ত মুক্তি
সমস্ত যোগের চূড়ান্ত পরিণতি — কর্ম, ভক্তি এবং জ্ঞান — হল মোক্ষ, জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি। এটি সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা, জীবন-মৃত্যুর দ্বৈততা থেকে স্বাধীনতা।
“মাং চ যোঽব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে। স গুণান্ সমতীতৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে॥” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৪.২৬
অর্থ: যিনি অবিচলিত ভক্তিযোগে আমার সেবা করেন, তিনি ত্রিগুণকে অতিক্রম করেন এবং ব্রহ্মত্ব লাভের যোগ্য হন।
মোক্ষ কেবল মুক্তি নয় — এটি মিলন। এটি অনন্তের সাথে আত্মার একত্বের অভিজ্ঞতা। গীতা মোক্ষকে নির্ভীকতা, শান্তি এবং ঐশ্বরিক পরিপূর্ণতার অবস্থা হিসাবে উপস্থাপন করে।
মুক্ত আত্মা:
- সকল প্রাণীর মধ্যে ঈশ্বরকে দেখে,
- আসক্তি থেকে মুক্ত,
- সুখ বা দুঃখ দ্বারা অপ্রভাবিত থাকে,
- এবং পরমাত্মায় স্থির থাকে।
শ্রীকৃষ্ণ জাতি, জন্ম বা অতীত পাপ নির্বিশেষে বিশ্বাস ও ভক্তি সহকারে আত্মসমর্পণকারীদের এই চূড়ান্ত মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন।
“তেঽপি যান্তি পরাং গতিম।” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৯.৩২
তারাও সর্বোচ্চ গতি লাভ করে।
উপসংহার: সনাতন ধর্মের চিরন্তন পথ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, তার অষ্টাদশ উজ্জ্বল অধ্যায়ে, সনাতন ধর্মের মূল নির্যাসকে ধারণ করে — চিরন্তন ধর্ম যা আত্মাকে সময়ের মধ্য দিয়ে এবং তার বাইরেও পরিচালিত করে। এটি একটি কঠোর পথ প্রচার করে না বরং একটি একক দর্শনে সমন্বিত একাধিক পথ উপস্থাপন করে।
- আত্মা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা আসলে কে।
- কর্ম শেখায় কিভাবে সততার সাথে বাঁচতে হয়।
- ভক্তি শেখায় কিভাবে আমাদের হৃদয়ে ঈশ্বরকে অনুভব করতে হয়।
- জ্ঞান বাহ্যিকতার পিছনে মহাজাগতিক সত্য প্রকাশ করে।
- মোক্ষ সমস্ত দুঃখের বাইরে শান্তির প্রতিশ্রুতি দেয়।
বিভ্রান্তি, চাপ এবং আধ্যাত্মিক বিস্মৃতিতে পূর্ণ বিশ্বে, গীতা একটি চিরন্তন পথপ্রদর্শক হিসাবে জ্বলজ্বল করে, প্রতিটি আত্মাকে — ধর্ম বা জাতীয়তা নির্বিশেষে — তাদের প্রকৃত আত্মাকে উপলব্ধি করতে এবং সনাতন ধর্মের চিরন্তন পথে চলতে আমন্ত্রণ জানায়।