ব্যুরো নিউজ ১৫ জুলাই ২০২৫ : নবান্নের অলিন্দে টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার এন চন্দ্রশেখরণের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ রাজ্য-রাজনীতিতে নতুন গুঞ্জন তৈরি করেছে। টাটা কি তবে ‘বাম-বান্ধব’ তকমা ঝেড়ে ফেলে এবার ‘তৃণমূল-বান্ধব’ হতে চলেছে? আর এই জল্পনার আগুনে ঘি ঢেলেছেন স্বয়ং তৃণমূল কংগ্রেস নেতা কুণাল ঘোষ। সোমবার এক বণিক সভায় তিনি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা শুনে অনেকেই বলছেন, “অতীত ইতিহাস কি তবে কুণালবাবুর স্মৃতি থেকে মুছে গেছে, নাকি মুছে দিতে চাইছেন?”
“মমতা টাটার বিরোধিতা করেননি”: কুণালের ‘ঐতিহাসিক’ দাবি
কুণাল ঘোষের গলা যেন নতুন সুর তুলেছে। তিনি বুক ফুলিয়ে বলেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও দিন টাটার বিরোধিতা করেননি। তিনি কোনও দিন বলেননি যে শিল্প হবে না। বিরোধিতা ছিল পূর্বতন রাজ্য সরকারের নীতি নিয়ে। টাটার বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও বিরোধিতা ছিল না। বাম সরকার যেভাবে দো-ফসলি জমিগুলিকে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছিল, সেটা নিয়েই প্রতিবাদ করেছিলেন মমতা।”
কুণালবাবুর এই বক্তব্য শুনে অনেকেই অবাক হচ্ছেন। কারণ, সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো কারখানার বিরুদ্ধে জমি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই আন্দোলনই তাঁকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। প্রশ্ন উঠছে, সে সময় টাটার গাড়ির যন্ত্রাংশ বয়কটের ডাক, কারখানার গেট আটকে রাখা – এগুলি কি টাটার বিরোধিতা ছিল না? নাকি সেগুলিকে ‘শিল্পপতিদের হাতে জমি তুলে দেওয়ার নীতির’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে নতুন মোড়ক পরানো হচ্ছে? রতন টাটা কি তাহলে কেবল বাম সরকারের নীতির জন্যই ‘মাথায় বন্দুক ধরে ট্রিগার টেনে দেওয়া’র কথা বলেছিলেন?
রতন টাটার ‘বন্দুক-কথা’ এবং গুজরাটের ‘আশ্রয়’
এই প্রসঙ্গে প্রয়াত টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটার কিছু মন্তব্য ফিরে দেখা দরকার। সিঙ্গুর আন্দোলনের পর যখন ন্যানো প্রকল্প সিঙ্গুর থেকে সরাতে বাধ্য হলেন, তখন তাঁর অবিস্মরণীয় উক্তি ছিল, “If you hold a gun to my head, you can pull the trigger or take the gun away. But the head will not move, however Mamata Banerjee has pulled the trigger.” অর্থাৎ, “যদি আমার মাথায় বন্দুক ঠেকান, আপনি ট্রিগার টানতে পারেন বা বন্দুক সরিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু মাথা সরবে না, তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ট্রিগার টেনেছেন।” এর চেয়ে স্পষ্ট করে কেউ টাটার ‘অসহায়তা’ আর ‘বিতাড়ন’ ব্যাখ্যা করতে পারে না।
শুধু তাই নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়েও (২০১৭ সালে), রতন টাটা ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের লেডিজ স্টাডি গ্রুপের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “In hindsight, it was a prudent decision given the hostile circumstances in Singur. But that move gave us a high negative cost.” অর্থাৎ, “পিছনের দিকে তাকালে, সিঙ্গুরের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এটি একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সেই পদক্ষেপ আমাদের জন্য একটি উচ্চ নেতিবাচক খরচ এনেছিল।”
আজীবন রতন টাটা তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন এই বলে যে, “was grateful to him for giving Nano a home at Sanand in Gujarat.” অর্থাৎ, ন্যানোকে গুজরাটের সানন্দে একটি ঘর দেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কুণাল ঘোষের বর্তমান বক্তব্যের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
সিঙ্গাপুর থেকে মাদ্রিদ: শিল্পের নতুন আখ্যান?
বিখ্যাত জেলখাটা মুখপাত্র আরও বলেছেন, “২০০৫ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিঙ্গাপুরে গিয়ে শিল্প নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মাদ্রিদে গেলেন, সেখানকার শিল্পপতিরা তাঁর প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন। রাজ্যের শিল্প ও শিল্পবান্ধব পরিস্থিতিতে যে অনেকটাই বদল এসেছে, এটা তারই প্রমাণ।”
বিরোধীরা অবশ্য এই ‘বদল’ মানতে নারাজ। তাদের অভিযোগ, রাজ্যের বর্তমান শাসকদল ও শিল্পের সম্পর্ক এখনও নেতিবাচক। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের সময় টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের সঙ্গে মমতার ফোনে কথা হয়েছিল বলে জানা গেলেও, সম্মেলনে টাটা গোষ্ঠীর কোনো প্রথম সারির প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।
বাস্তব পরিস্থতিতে রাজ্যে শুধু প্রকল্পের ঘোষণা হয়, শিল্প আর কর্মসংস্থান অধরাই থেকে যায়। টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধারের এই নবান্ন আগমন এবং কুণাল ঘোষের এই ‘আবেগঘন’ ভাষণ, বাংলার শিল্প আকাশে নতুন কোনো বড় বিনিয়োগের মেঘ নিয়ে আসে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। নাকি সিঙ্গুরের মতো এবারও ‘শুধু ঘোষণা’তেই শেষ হবে বাংলার শিল্প স্বপ্ন?