history of beck bagan

মিঠুন ভট্টাচার্য , ১৩ জুলাই ২০২৫ : কলকাতার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অজস্র ইতিহাস, যেগুলি আমাদের চেনা রাস্তা, পাড়া বা অলিগলির আড়ালে লুকিয়ে থাকে নীরব সাক্ষী হয়ে। এমনই একটি পাড়া “বেগ বাগান”। মধ্য কলকাতার এই স্থানটির নাম শুনলে প্রথমেই মনে হতে পারে এটি কোনো সাধারণ বাগানসংলগ্ন এলাকা। কিন্তু এর পেছনের ইতিহাস অনেক গভীর এবং রোমাঞ্চকর। এটি এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব “হায়দার বেগ খান”-এর স্মৃতিবিজড়িত স্থান।

“বেক সাহেব কা বাগিচা” থেকে “বেগ বাগান”

১৮২৫ সালের শার্ল সাহেবের আঁকা কলকাতার একটি পুরনো মানচিত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, বর্তমানের বেগ বাগান চিহ্নিত হয়েছে “Beck Saheb ka Bagicha” নামে। কিন্তু কে এই “Beck Saheb”? একটু খোঁজ নিলে জানা যায়, এই Beck শব্দটি বাংলায় এসে “বেগ”-এ বিকৃত হয়েছে, আর বেগ সাহেব ছিলেন হায়দার বেগ খান — নবাবী ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।

পটলডাঙার ২০ নম্বর বাড়ির আড্ডা থেকে ইতিহাসে জায়গা

হায়দার বেগ খান: নবাবী দরবারের প্রভাবশালী দূত

হায়দার বেগ খান ছিলেন লখনৌ-এর নবাব আসফ-উদ-দৌল্লা-এর প্রধান উপদেষ্টা ও দূত। সে সময় নবাবের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হাসান রাজাক খান, যিনি নিজে ছিলেন সম্পূর্ণ নিরক্ষর। প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে তাঁর বিশেষ সহচর হায়দার বেগ খানের ওপর। এই কারণেই তিনি নবাবী দরবারে দ্রুতই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।

কলকাতায় এক জাঁকজমকপূর্ণ কূটনৈতিক সফর

১৭৮৭ সালে হায়দার বেগ খান কলকাতায় আসেন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কনওয়ালিস-এর সঙ্গে একটি কূটনৈতিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করার জন্য। কিন্তু এটি ছিল নিছক একটি সফর নয়, বরং এক বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ কূটনৈতিক মিশন। বলা হয়, তাঁর সফরের বহর এতটাই বড় ছিল যে লখনৌ থেকে কলকাতায় পৌঁছাতে প্রায় চার মাস সময় লেগে যায়।

তাঁর সঙ্গে এসেছিল প্রায় ৬ কোম্পানি সিপাহী সেনা, ১৫০ ঘোড়সওয়ার, হাতি, উট এবং অসংখ্য সহচর। এই রাজকীয় সফর ছিল এক কথায় বিস্ময়কর, এবং সেই সময় কলকাতাবাসীর কাছে এক বিরল দৃশ্য।

এই সফরের একটি দৃশ্য অঙ্কিত করেছিলেন কলকাতায় অবস্থানরত জার্মান চিত্রশিল্পী জোহান জফ্যানি (Johann Zoffany)। তিনি সেই দৃশ্যের চিত্রকর্মটির নাম দেন “The Embassy of Haider Beck”, যেটি আজও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এ সংরক্ষিত রয়েছে। এই চিত্রটি একদিক দিয়ে কলকাতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত — যা প্রমাণ করে একসময় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই কূটনৈতিক সফর এবং তার সঙ্গে জড়িত স্থানগুলো।

বাগবাজার: ইতিহাস, মনীষী আর সংস্কৃতির উত্তর কলকাতার মহাতীর্থ

কীভাবে হলো “বেগ বাগান” নামকরণ?

হায়দার বেগ খানের কলকাতায় থাকার জন্য যে স্থানে তাঁবু গাড়া হয়েছিল, সেটা ছিল জনৈক ব্রিটিশ ব্যক্তি গ্ল্যাডউইনের পুরনো বাড়ি। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা সেই প্রাঙ্গণেই তাঁবু ও বিশ্রামের ব্যবস্থা হয়। অত বিশাল বহর ও বিশিষ্ট অতিথিকে ঘিরে এলাকাটি বিখ্যাত হয়ে যায় “বেগ সাহেব কা বাগিচা” নামে — অর্থাৎ বেগ সাহেবের বাগান। কালের পরিবর্তনে, ভাষার বিবর্তনে এবং স্থানীয় উচ্চারণের কারণে “বেগ সাহেব কা বাগিচা” থেকেই রূপান্তর ঘটে আজকের “বেগ বাগান” নামটিতে।
এই নামকরণ কেবল একটি এলাকার নাম নয়, বরং এটি বহন করে একটি যুগের ছাপ। এটি একদিকে যেমন নবাবী ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনামলের সম্পর্কের নিদর্শন, তেমনি ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া এক ব্যক্তিত্বের স্মৃতি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই বিশাল ঘটনাটি আজ অনেকটাই বিস্মৃত, এবং আমরা জানি না এমন অনেক অলিগলি, স্থাননাম ঠিক কাদের স্মৃতিতে গড়ে উঠেছে।

বেগ বাগান এরকমই এক ঐতিহাসিক স্থান, যার পেছনে রয়েছে এক বিস্মৃত নবাবী দূতের গল্প, যার প্রভাবে এক কালে কলকাতার বুকে গড়ে উঠেছিল এক রাজকীয় শিবির। ভবিষ্যতে যদি কখনও আপনি হাঁটতে হাঁটতে বেগ বাগান পৌঁছে যান, একটু থেমে চেয়ে দেখবেন চারপাশে — কে জানে, হয়তো ইতিহাস এখনো সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর