ব্যুরো নিউজ ০৯ জুলাই ২০২৫ : পশ্চিমবঙ্গে নাকি গণতন্ত্রের মেলা বসেছে! তবে সেই মেলায় টিকিট কাটার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন খোদ শাসকদলের নেতারাই। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে কলেজে ছাত্রদের ভর্তি, এমনকি নিজের দলের ভেতরে নির্বাচনে মনোনয়ন বা দলীয় পদ প্রাপ্তি – সর্বত্রই ‘স্বচ্ছ লেনদেনের’ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার সেই ‘স্বচ্ছতার’ নিশানায় এলেন খোদ এক মন্ত্রী! রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরাসরি ৪০ লক্ষ টাকা নিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ পাইয়ে দেওয়ার এবং পরে খুনের হুমকি দেওয়ার মতো মারাত্মক অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূলেরই এক পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী। এ যেন ‘তোলাবাজি সংস্কৃতি’র নতুন এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়।
পদ-প্রাপ্তি: ৪০ লক্ষের খেলা, জীবনের ঝুঁকি
মন্তেশ্বর মেমারি (২) পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল নেত্রী ও সভানেত্রী ময়না হালদার টুডু বোমা ফাটিয়েছেন। তার অভিযোগের সারমর্ম হল, মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী নাকি তার কাছ থেকে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হওয়ার জন্য ৪০ লক্ষ টাকা নিয়েছেন। ময়না হালদার টুডু সবিস্তারে বলেছেন, “সভাপতি হওয়ার দেড় থেকে দু’ সপ্তাহ আগে ৩ খেপে টাকাটা আমার কাছে নিয়েছে। আমি সাতগাছিয়া MLA অফিসে দিয়েছি। আর নিজে গিয়ে আমি কলকাতা বাগরা অফিসে গিয়ে দিয়ে এসেছি।” বোঝা যাচ্ছে, লেনদেন পদ্ধতি ছিল বেশ সংগঠিত, কোনো রাস্তার মোড়ের চুক্তি নয়!
তবে আসল নাটক শুরু হয়েছে টাকা দেওয়ার পর। ময়না হালদার টুডু অভিযোগ করেছেন, “এখন মুখ খুলতে হচ্ছে এই কারণে, উনি (সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী) আমার সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করছেন, আমার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পঞ্চায়েত সমিতিতে আমাকে কোনও কাজও করতে দিচ্ছে না।” অর্থাৎ, পদ পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু কাজের স্বাধীনতা হয়তো ‘তোলা’র সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে গেছে।
খুনের হুমকি: মন্ত্রীর নাকি অনুগামীদের ‘দাওয়াই’
কেবল আর্থিক লেনদেনেই কাহিনি শেষ হয়নি, এবার এসেছে প্রাণহানির হুমকি। ময়না হালদার টুডু দাবি করেছেন, “আমাকে মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী মার্ডার করার হুমকি দিয়েছে ওই ৭ জন যারা আছে তাদের মারফত। এটাও আমি বলছি, আমার জীবনের প্রচুর রিস্ক আছে। উনি (সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী) আমাকে যখন-তখন খুন করে দিতে পারে।” অর্থাৎ, পদাধিকারী হওয়ার জন্য অর্থ প্রদান করা সত্ত্বেও, এখন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাকে পুলিশের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এ যেন ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’-এর এক নতুন ভার্সন, যেখানে কন্ট্রাক্টটা রাজনৈতিক পদ পাওয়ার, আর কিলিং-এর হুমকিটা আসছে কন্ট্রাক্ট দেওয়া ব্যক্তির কাছ থেকেই!
ময়না হালদার টুডু এই অভিযোগ নিয়ে পুলিশ সুপারের দ্বারস্থ হয়েছেন। এর পাল্টা, মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীও ময়নার অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। কিছুদিন আগেই তৃণমূলেরই একাংশের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, যা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমার ইজ্জত নিয়ে বারবার খেলা হলে, দল ছেড়ে দেব আমি। আমার ভবিষ্যৎ আমি বুঝে নেব, কী হবে না হবে।” তখন তার গলায় ছিল ক্ষোভের সুর, এখন যেন কিছুটা নরম। তিনি বলেছেন, “মন্তেশ্বরের ব্যাপারে আমি একটা ছবি… মানে দুর্বৃত্তায়নের ছবি, তোলাবাজদের ছবি তুলে ধরেছি এবং মুখ্যমন্ত্রী এটা আশ্বস্ত করেছেন, এই তোলাবাজি আমি চলতে দেব না।” প্রশ্ন হলো, এই ‘তোলাবাজি’র চক্রে কে ‘তোলা’ নিচ্ছে আর কে ‘তোলা’ দিচ্ছে, সেই সীমারেখা কি আরও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে?
Suvendu vs Mamata : পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবিতে রাজনৈতিক বিতর্ক !
‘ভাইপো গ্যাং’ থেকে মন্ত্রী: বাংলার রাজনৈতিক আন্ডারওয়ার্ল্ড?
এই ঘটনা রাজ্যের সেই বৃহত্তর ‘তোলাবাজি’ র্যাকেটকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে, যা শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে দলীয় পদ প্রাপ্তি পর্যন্ত বিস্তৃত বলে অভিযোগ। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রায়শই ‘ভাইপো গ্যাং’-এর কথা বলেন, যারা কলেজে কলেজে ক্ষমতার অপব্যবহার করে। গতকাল শুভেন্দু ৫০ জন তথাকথিত ‘ভাইপো গ্যাং’ সদস্যের তালিকা প্রকাশ করে অভিযোগ করেছেন, “মনোজিত মিশ্রের মতো বহু ছাত্রী নির্যাতনকারী আজ কলেজ চত্বরে ক্ষমতার রক্ষাকবচ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।” তিনি আরও দাবি করেছেন, এই ছাত্ররাই ‘ভাইপোর হয়ে টাকা তোলার কাজ করে।’
এই পরিস্থিতিতে, দলেরই একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন তার নিজের দলের নেত্রী প্রকাশ্যে টাকা নেওয়ার এবং খুনের হুমকির অভিযোগ তুলছেন, তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক – এই ‘তোলাবাজি সংস্কৃতি’র বিস্তার কি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত এতটাই গভীরে পৌঁছে গেছে যে স্বয়ং মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠছে? নাকি এটি ‘তোলাবাজি’র সাম্রাজ্যে কে কত বড়, সেই ক্ষমতার লড়াইয়েরই এক অংশ? বিধানসভা ভোটের মুখে এই বিতর্ক নিঃসন্দেহে শাসকদলের জন্য নতুন অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলবে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘তোলাবাজি’র এই অন্দরমহল কি ‘গণতন্ত্রের উৎসব’-এর আড়ালে এক বিশাল ‘সিন্ডিকেট রাজ’-এর ইঙ্গিত দিচ্ছে? সময়ই বলবে।