ব্যুরো নিউজ ০৮ জুলাই ২০২৫ : একদিকে যখন রাজ্য সরকারের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ, ঠিক তখনই দেশজুড়ে বেসরকারীকরণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে সরব বাম ও অতিবাম শ্রমিক সংগঠনগুলি। আগামীকাল, বুধবার, ৯ই জুলাই, ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ মঞ্চের ডাকে দেশজুড়ে পালিত হবে ‘ভারত বনধ’। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে ২৫ কোটিরও বেশি শ্রমিক এই ধর্মঘটে যোগ দিতে প্রস্তুত। এই বনধ ব্যাংক, বীমা, পরিবহন, বিদ্যুৎ এবং ডাক পরিষেবা সহ একাধিক জরুরি পরিষেবা ব্যাহত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কৃষক গোষ্ঠী এবং গ্রামীণ শ্রমিক সংগঠনগুলিও এই ধর্মঘটে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।
ধর্মঘটের নেপথ্যে কী?
যৌথ ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের দাবি, সরকারের “শ্রমিকবিরোধী, কৃষকবিরোধী এবং কর্পোরেটপন্থী নীতির” বিরুদ্ধে এই ধর্মঘট। তাদের উত্থাপিত মূল সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে:
- চারটি নতুন শ্রম সংহিতা (Labour Codes) চাপিয়ে দেওয়া।
- রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং জরুরি পরিষেবাগুলির বেসরকারীকরণ।
- স্থায়ী চাকরিতে আউটসোর্সিং এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধি।
- সম্মিলিত দর কষাকষির অধিকার এবং ইউনিয়ন কার্যক্রম দুর্বল করা।
- গত এক দশক ধরে কোনো বার্ষিক শ্রম সম্মেলন (Annual Labour Conference) অনুষ্ঠিত না হওয়া।
ইউনিয়নগুলি জানিয়েছে, তারা পূর্বে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের কাছে একটি ১৭-দফা দাবিপত্র জমা দিয়েছিল, কিন্তু তাদের অভিযোগ, এ বিষয়ে কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি।
কারা অংশ নিচ্ছেন এই ধর্মঘটে?
এআইটিইউসি (AITUC – All India Trade Union Congress), আইএনটিইউসি (INTUC – Indian National Trade Union Congress), সিআইটিইউ (CITU – Centre of Indian Trade Unions), এইচএমএস (HMS – Hind Mazdoor Sabha), এআইইউটিইউসি (AIUTUC), সেবা (SEWA), এআইসিসিটিইউ (AICCTU), টিইউসিসি (TUCC), এলপিএফ (LPF), ইউটিইউসি (UTUC) সহ প্রধান ইউনিয়নগুলির নেতারা ধর্মঘটে অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এআইটিইউসি-র অমরজিৎ কৌর-এর মতে, নির্মাণ, খনিজ, পরিবহন, উৎপাদন, ব্যাংক, বীমা এবং কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত ২৫ কোটিরও বেশি শ্রমিক এতে যোগ দিতে চলেছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২৭ লক্ষ বিদ্যুৎ কর্মী সমর্থন জানিয়েছেন। ব্যাংক ও বীমা কর্মীরা দেশজুড়ে ধর্মঘটে থাকবেন, এবং বেশ কয়েকটি রাজ্যে ডাক ও গণপরিবহন কর্মীরা কাজ থেকে বিরত থাকতে পারেন। ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র ও ওড়িশার শিল্পাঞ্চলে কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। যদিও ভারতীয় রেলওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মঘটের অংশ নয়, তবে ইউনিয়ন নেতারা সড়ক অবরোধ ও প্রধান জংশনে সম্ভাব্য বিলম্বের বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
কোন পরিষেবাগুলি প্রভাবিত হবে এবং কোনটি খোলা থাকবে?
যদিও সরকার কোনো সরকারি ছুটি ঘোষণা করেনি, তবে দেশের অনেক অংশে জরুরি পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা:
- সরকারি এবং সমবায় ব্যাংক (সীমিত বা কোনো কার্যক্রম থাকবে না)।
- বীমা পরিষেবা (এলআইসি, জিআইসি, বেসরকারি খাতের কর্মীদের অংশগ্রহণ পরিবর্তিত হতে পারে)।
- ডাক পরিষেবা।
- নির্বাচিত রাজ্যগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ।
- গণপরিবহন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যগুলিতে যেখানে শক্তিশালী ইউনিয়ন উপস্থিতি রয়েছে।
- কয়লা খনিজ এবং ইউনিয়নভুক্ত খাতের শিল্প উৎপাদন।
- ইস্পাত, বিদ্যুৎ, টেলিকম, তেল ও গ্যাস খাতের কর্মীরাও অংশ নিতে পারেন।
- পরিকাঠামো এবং নির্মাণ সাইট, এনএইচএআই (NHAI) প্রকল্প সহ।
খোলা থাকার সম্ভাবনা:
- স্কুল ও কলেজ (যদি না স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বন্ধের আদেশ জারি করে)।
- বেসরকারি অফিস ও আইটি সংস্থা, যদিও পরিবহন ব্যাহত হওয়ার কারণে কর্মীদের পৌঁছাতে দেরি হতে পারে।
- হাসপাতাল ও জরুরি পরিষেবা, যা ধর্মঘটের আওতামুক্ত।
- রেলওয়ে কার্যক্রম, যদিও সামান্য বিলম্ব সম্ভব।
কৃষকরা কেন সমর্থন করছেন?
২০২০-২১ সালের কৃষক আন্দোলনের পিছনে থাকা কৃষক জোট সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (SKM) এই বনধকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং কর্ণাটকের কৃষক ইউনিয়নগুলি গ্রামীণ প্রতিবাদ জোরদার করছে। তাদের মূল দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (MSP) জন্য আইনি গ্যারান্টি।
- ক্রমবর্ধমান ইনপুট খরচ এবং স্থবির উৎপাদন মূল্য নিয়ন্ত্রণ।
- কৃষি বাজারের বেসরকারীকরণ এবং ভূমি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
- এমএনআরইজিএ (MNREGA) কাজ, সার ভর্তুকি এবং খাদ্য রেশনে কাটছাঁট বন্ধ করা।
বর্তমান পরিস্থিতি ও অসন্তোষের কারণ
ইউনিয়ন নেতারা বলছেন, গত ধর্মঘটগুলির পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সিএমআইই (CMIE) তথ্য অনুযায়ী, যুব বেকারত্ব প্রায় রেকর্ড ১৭ শতাংশে পৌঁছেছে। শহুরে কেন্দ্রগুলিতে ডাল ও সবজির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের খুচরা মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতের কর্মীদের প্রকৃত মজুরি স্থবির রয়েছে। প্রতিরক্ষা ও শক্তি সহ কৌশলগত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারীকরণ বা কর্পোরেটাইজেশন করা হচ্ছে। কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে সরকারি ব্যয় কমেছে। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় নজরদারি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নগুলি মহারাষ্ট্রে পাবলিক সিকিউরিটি বিল, প্রতিবাদ চলাকালীন ইন্টারনেট বন্ধ এবং বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের মাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিকদের ভোটাধিকার হরণের চেষ্টার অভিযোগ তুলেছে।
Suvendu vs Mamata : পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবিতে রাজনৈতিক বিতর্ক !
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গি
শ্রম মন্ত্রক বনধের আগে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করেনি। তবে, কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন যে, চারটি শ্রম সংহিতা সম্মতি সরলীকরণ, ব্যবসা করার সুবিধা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানকে আনুষ্ঠানিক করার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সরকার যুক্তি দেয় যে, এই সংস্কারগুলি ‘দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া’ ছিল এবং বহু পুরনো আইনকে প্রতিস্থাপন করবে। কিন্তু ইউনিয়নগুলি জোর দিয়ে বলছে যে, কোনো প্রকৃত আলোচনা হয়নি, এবং তারা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সংসদীয় তদারকি ছাড়াই রাজ্য সরকারগুলির মাধ্যমে সংস্কার আনার অভিযোগ তুলেছে। যদি গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলিতে পরিষেবা ব্যাহত হয়, তাহলে কিছু রাজ্য অত্যাবশ্যক পরিষেবা রক্ষণাবেক্ষণ আইন (ESMA) প্রয়োগ করতে পারে। তবে, এখনও পর্যন্ত এমন কোনো আদেশ প্রকাশ্যে আসেনি।
অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ উদ্বেগ
যখন দেশের অর্থনীতিতে উন্নতির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে এই ধরনের ধর্মঘট দেশের অর্থনীতিকে বন্ধক রেখে দাবি আদায়ের নেতিবাচক প্রচেষ্টা। উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে এবং সরকারি ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় আবার কি স্থবির হবে গোটা ভারত ? সমস্ত প্রগতিশীল ভারতবাসির একই প্রশ্ন ।