ব্যুরো নিউজ ০২ জুলাই : তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা আজ এক যুগান্তকারী ঘোষণা করেছেন, যা তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ নিরসন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাঁর ৯০তম জন্মদিনের (৬ই জুলাই) ঠিক আগে দেওয়া এই বিবৃতিতে দালাই লামা স্পষ্ট করেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরেও আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানটি অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং তাঁর উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে “মুক্ত তিব্বতিদের” উপরই বর্তাবে। চিনের তিব্বত দখলদারিত্ব এবং অতীতে দালাই লামার উত্তরসূরি অপহরণের প্রেক্ষাপটে এই ঘোষণা এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে, কারণ এটি তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের নেতৃত্বকে চিনা প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
দালাই লামা প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা ও বিশ্বব্যাপী আবেদন
দালাই লামা তাঁর বিবৃতিতে জানান যে, গত ১৪ বছর ধরে তিব্বতি নির্বাসিত সম্প্রদায়, হিমালয় অঞ্চল, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, চিন এবং তিব্বতের অভ্যন্তরের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাঁর প্রতি এই প্রথা অব্যাহত রাখার জন্য অসংখ্য অনুরোধ জানিয়েছেন। ধর্মশালায় একটি ধর্মীয় সমাবেশে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে দালাই লামা ঘোষণা করেন, “এই সমস্ত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে, আমি নিশ্চিত করছি যে দালাই লামার প্রতিষ্ঠানটি অব্যাহত থাকবে।”
Bihar ; বিহারের ঐতিহাসিক ই-ভোটিং উদ্যোগ: গণতন্ত্রে নতুন দিগন্ত?
উত্তরসূরি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া: চিনের হস্তক্ষেপের অবসান
দালাই লামা তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনের পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্টীকরণ দিয়েছেন। তিনি জানান যে, “ভবিষ্যত দালাই লামাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি ২০১১ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বরের বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে এই দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে গাদেন ফোদ্রাং ট্রাস্ট, অর্থাৎ মহামান্য দালাই লামার কার্যালয়ের সদস্যদের উপরই বর্তাবে।” তিনি আরও বলেন, এই ট্রাস্টকে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন প্রধান এবং দালাই লামার বংশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত বিশ্বস্ত ধর্ম রক্ষকদের (Dharma Protectors) সাথে পরামর্শ করতে হবে। সে অনুযায়ী, অতীতের ঐতিহ্য মেনে অনুসন্ধান ও স্বীকৃতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
কেন্দ্রীয় তিব্বত প্রশাসনের প্রেসিডেন্ট পেনপা সেরিং সিকিয়ং ধর্মশালায় সাংবাদিকদের জানান, ১৫তম তিব্বতি ধর্মীয় সম্মেলনে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে যে, দালাই লামার পুনর্জন্মকে স্বীকৃতি দেওয়ার মূল প্রক্রিয়াটি তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের অনন্য ঐতিহ্য অনুযায়ী হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “সুতরাং, আমরা শুধু চিন কর্তৃক পুনর্জন্মের বিষয়টিকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করি না, বরং আমরা এটিকে কখনোই মেনে নেব না।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তিব্বতের অভ্যন্তরে এবং বাইরে উভয় জায়গার তিব্বতিরা জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার এবং দালাই লামার মহৎ ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন।
১৯৫৯ সাল থেকে নির্বাসিত জীবন ও উত্তরসূরি নিয়ে উদ্বেগ
দালাই লামা এবং হাজার হাজার তিব্বতি ১৯৫৯ সালে লাসায় চিনা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিদ্রোহের পর ভারতে আশ্রয় নেন। তারপর থেকে তিনি নির্বাসন থেকেই তিব্বতি সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। দালাই লামার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে তিব্বতিদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দেয়। অনেকেই আশঙ্কা করেন যে, চিন তিব্বতের উপর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করার জন্য তাদের নিজস্ব দালাই লামা নিয়োগ করতে পারে। অতীতে, চিনা কর্তৃপক্ষ এক তরুণ পাঞ্চেন লামাকে অপহরণ করে তাদের নিজেদের পছন্দের পাঞ্চেন লামা নিয়োগ করেছিল, যা বৌদ্ধ সমাজে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। এই ঘটনা তিব্বতি বৌদ্ধ নেতৃত্বকে দূষিত করার এবং তিব্বতিদের মধ্যে বিদ্রোহের কারণ নির্মূল করার চিনা স্বৈরাচারের প্রচেষ্টার প্রমাণ।
চিনের ভূমিকা প্রত্যাখ্যান: তিব্বতীয় ট্রাস্টের একচেটিয়া কর্তৃত্ব
এই উদ্বেগ নিরসনে দালাই লামা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, শুধুমাত্র তাঁর অফিসিয়াল কার্যালয়, গাদেন ফোদ্রাং ট্রাস্টের-ই পরবর্তী দালাই লামাকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা থাকবে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, “এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার আর কারো কোনো ক্ষমতা নেই।”
যদিও চিন দালাই লামাকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখে চলেছে, তিনি নিজেকে কেবল একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবেই বর্ণনা করেন। তাঁর এই সর্বশেষ ঘোষণাকে তিব্বতি ঐতিহ্যকে বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করার একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি তিব্বতি জনগণের মধ্যে ঐক্য ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যা চিনের তিব্বতের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।