ব্যুরো নিউজ ২৭ জুন: পুরীর জগন্নাথ ধামের রথযাত্রার মতোই বাংলার রথযাত্রা উৎসবের এক বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। কলকাতা ও মায়াপুরে ইসকনের জাঁকজমকপূর্ণ রথযাত্রা ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় মহা সমারোহে এই উৎসব পালিত হয়। বাংলার পথঘাটে শিশুরা নিজেদের তৈরি বা কেনা ছোট রথ নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়, যা এই উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। তবে এই সমস্ত আয়োজনের মধ্যে, হুগলি জেলার মহেশে অবস্থিত জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা তার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য এবং ব্যাপক ভক্ত সমাগমের জন্য স্বতন্ত্র।
মহেশ রথযাত্রার ঐতিহাসিক পটভূমি
হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মহেশে অবস্থিত জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা কেবল বাংলার নয়, ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম রথযাত্রা হিসেবে পরিচিত। এর ইতিহাস প্রায় ৬২৭ বছরেরও বেশি পুরনো। জনশ্রুতি আছে, এই রথযাত্রার সূচনা করেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম পার্ষদ, শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং। যদিও প্রামাণ্য ইতিহাস অনুযায়ী, এটি পঞ্চদশ শতকে বাংলার সাধক দ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর হাত ধরে শুরু হয়েছিল। কথিত আছে, পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে গিয়ে দ্রুবানন্দকে ভোগ নিবেদন করতে বাধা দেওয়া হলে, ভগবান জগন্নাথ স্বপ্নে তাঁকে মহেশে ফিরে গিয়ে দারু-ব্রহ্ম (নিম গাছের কাণ্ড) থেকে মূর্তি তৈরি করার নির্দেশ দেন। এরপর তাঁর শিষ্য কমলাকর পিপলাই মহেশ মন্দিরে জগন্নাথ দেবের পূজা ও রথযাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে যে বিশাল রথটি ব্যবহৃত হয়, সেটি ১৮৮৫ সালে মার্টিন বার্ন কোম্পানি দ্বারা নির্মিত, যা ইস্পাত কাঠামো এবং কাঠের মাচান দ্বারা গঠিত একটি নয়-রত্ন শৈলীর মন্দির। প্রায় ৫০ ফুট উচ্চতার এই রথটি ১২টি চাকার উপর দাঁড়িয়ে আছে।
রথযাত্রার গৌরবময় ইতিহাস: ভারতীয় সংস্কৃতির চাকা ঘোরে যেখান থেকে
নবযৌবন উৎসব: মহেশের বিশেষ আচার
মহেশ জগন্নাথের রথযাত্রা শুরুর ঠিক ১৫ দিন আগে একটি বিশেষ উৎসব পালিত হয়, যা নবযৌবন বা নবকলেবর উৎসব নামে পরিচিত। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে ১০৮ ঘটি সুগন্ধি জল দিয়ে স্নান করানো হয়, যাকে স্নানযাত্রা বলা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই স্নানের ফলে দেবতারা জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর ১৫ দিনের জন্য তাঁদের গর্ভগৃহে বিচ্ছিন্নভাবে রাখা হয়, যা ‘অনসর ঘর’ নামে পরিচিত। এই সময়ে মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে এবং ভক্তদের কীর্তনও বন্ধ থাকে। এই ১৫ দিন দেবতারা ভেষজ ঔষধ ও সাধারণ ভোগ গ্রহণ করেন এবং মূল বিগ্রহের পরিবর্তে পটচিত্রের মাধ্যমে তাঁদের দর্শন করানো হয়।
১৫ দিন পর মহাপ্রভু সুস্থ হয়ে উঠলে সেই দিনটিকে নবযৌবন উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। এই বিশেষ দিনে ভগবানকে ‘ছাপ্পান্ন ভোগ’ নামে পরিচিত ৫৬ ধরনের খাবার নিবেদন করা হয়। এই দিনেই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা নতুন গহনা এবং রাজকীয় পোশাকে সজ্জিত হন। মহেশের নবযৌবন উৎসবের দিন জগন্নাথ দেবকে রূপার হাত পরানো হয়। প্রচলিত বিশ্বাস, এই দিনে জগন্নাথ দেব জ্বর থেকে সুস্থ হয়ে এক আনন্দময় অবস্থায় থাকেন এবং মন্দিরের দরজা ভক্তদের জন্য প্রথমবারের মতো খুলে দেওয়া হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, এই দিনে জগন্নাথ দেব রাজকীয় বেশে আবির্ভূত হন এবং দুই হাতে সকল ভক্তকে আশীর্বাদ করেন। এই দিনেই জগন্নাথ দেবের শরীরে হাত দেখা যায় বলে ধারণা করা হয়।
শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রা: ভক্তি, আধ্যাত্মিকতা ও মানবতার এক মহাযাত্রা
বাংলার রথযাত্রা: সর্বজনীন আনন্দ ও রথের মাহাত্ম্য
রথযাত্রা উপলক্ষে বাংলার আনাচে-কানাচে উৎসবের এক ভিন্ন মেজাজ দেখা যায়। এই উৎসব সম্পূর্ণ ভক্তি ও বিশ্বাস সহকারে অনুসরণ করা হয়। শিশুরা নিজেদের ছোট আকারের রথ নিয়ে রাস্তায় বের হয়, যা সাধারণত ১ থেকে ১.৫ ফুট উঁচু হয়। এই ছোট রথগুলি ফুল এবং রঙিন কাগজ দিয়ে সজ্জিত থাকে এবং এতে জগন্নাথ দেব, সুভদ্রা ও বলরামের প্রতিমা স্থাপন করা হয়। এই উৎসবগুলি কেবল ধর্মীয় আচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি এক সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একসঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেয়।
রথযাত্রা বাংলা এবং গোটা দেশের আবেগ, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের এক জীবন্ত প্রতীক।