ইভিএম নিউজ ব্যুরো, ২ মার্চঃ “শিক্ষা রে শিক্ষা তুই আজ ব্যবসার রাজা, তোরে নিয়ে সবাই ব্যবসা করছে করছে ভুঁড়ি তাজা!” ২০১১ সালে বাম জমানার অবসানের পর থেকে তৃণমূল পরিচালিত সরকারের তত্ত্বাবধানে চলা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের তরুণ কবি ফাইয়াজ ইসলাম ফাহিমের লেখা ‘শিক্ষা ব্যবসা’ কবিতার এই লাইনটিকে।মমতার শাসনকালে একদিকে যেমন শিক্ষা দফতরের প্রায় সমস্ত শীর্ষ কর্তারা কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের কাছে শিক্ষক পদকে বিক্রি করেছেন অন্যদিকে খোদ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সেই কুকর্মের ভাগীদার হয়ে নিজের স্থূল উদর তৈরি করেছেন।

২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এলাকায় শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম অভিযুক্ত তাপস মণ্ডলের(মানিক ভট্টাচার্য ঘনিষ্ঠ) ভাড়া করা একটি বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি তথা তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য ও গরু পাচার মামলায় জেল বন্দী তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বীরভূমেরই এক দাপুটে নেতাকে সামনে রেখে ‘বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স অ্যাসোসিয়েশন’ নামে বেসরকারি বিএড ও ডিএলএড কলেজ সংগঠন চালু করা হয়।পরবর্তীতে এই সংগঠনের দায়িত্ব নেন তাপস মণ্ডল। অনুব্রত ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং বেসরকারি কলেজের মালিকেরা এই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন বলেও জানা যায়।ইডি সূত্রের দাবী, এই সংগঠনের মাধ্যমেই ডিএলএড কলেজের অনুমোদনের ছাড়পত্র বাবদ ৫০ হাজার টাকা করে নেওয়া শুরু হয় এবং এটাই শিক্ষায় বেআইনি নিয়োগ ও অবৈধ লেনদেনের সুত্রপাত। শিক্ষা-দুর্নীতির বিভিন্ন পর্যায়ের কথা জানিয়ে ইডির তদন্তকারী দল ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত বিভিন্ন বেসরকারি ডিএলএড কলেজের ছাড়পত্র, অনুমোদন, পুনর্নবীকরণ এবং অনলাইন ও অফলাইনে পড়ুয়া ভর্তির মাধ্যমে প্রায় ৩০ কোটি টাকার দুর্নীতি ইতিমধ্যেই সামনে এনেছে এবং এই সমগ্র পরিকল্পনার পিছনে নাম উঠে এসেছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বেসরকারি কলেজ সংগঠনের নেতা তাপস মণ্ডল ও সর্বোপরি রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের।
তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই একটি সংগঠনের ছাতার নীচে থেকে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে কীভাবে দুর্বৃত্তরাজ সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইডির প্রকাশিত উপরিউক্ত পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট।

ইডির আধিকারিকদের দাবি, করোনাকালে যখন দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ ছিল এবং অনলাইনে পড়াশোনার জন্য পরিকাঠামো গড়ার চেষ্টা করছিল রাজ্য সরকার তখন (D.El.Ed.) কলেজের পড়ুয়াদের অনলাইনে ক্লাস করানোর জন্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা জমা পড়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তৎকালীন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের পুত্র সৌভিক ভট্টাচার্যের একটি সংস্থাতে। অথচ, সেইসময় অনলাইন ক্লাসের জন্য কোন পরিকাঠামোই তৈরি হয়নি । এমনকি, মৃত এক ব্যক্তির সঙ্গে মানিকের স্ত্রী শতরূপা ভট্টাচার্যের একটি জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের যে হদিস মিলেছে, তাতে দুর্নীতির টাকা থাকতে পারে বলে অনুমান ইডি আদিকারিকদের। ওই টাকা কেন, কী ভাবে, কোন চুক্তির ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছিল, কেনই বা কাজ হয়নি, এই মর্মে মানিকের স্ত্রী ও পুত্রকে ইডির দফতরে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সেই প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তারা।আদালতের নির্দেশে ইতি মধ্যেই সপরিবারে হাজত বাস করছেন প্রাক্তন পর্ষদ সভাপতি।

ইডির তদন্তকারী দল ২০১২ থেকে ২০১৭-র মধ্যবর্তী পর্যায়ের দুর্নীতির নথি ঘাঁটতে শুরু করলে এই সময়ের ব্যবধানে মাথা পিছু ৬ থেকে ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার অবৈধ নিয়োগের সন্ধান পায়। ২০১৬ তে আয়োজিত প্রাথমিক টেট পরীক্ষার ভিত্তিতে নবম-দশমে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার, একাদশ-দ্বাদশে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করেছিলো এসএসসি। গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি পদে নিযুক্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ছ’হাজার।সব মিলিয়ে নিয়োগের সংখ্যাটা ছিল ২৩ হাজারের কাছাকাছি।কিন্তু ওএমআর শিটে জালিয়াতির পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি নিয়োগেই ভুরি ভুরি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্ত শুরু করে সিবিআই। তদন্তকারীরা জানতে পারে , মূলত এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য, প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা, অশোক সাহা এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়রা পরিকল্পনামাফিক অযোগ্য প্রার্থীদের OMR শিটে জালিয়াতির কাজ চালিয়েছিলেন। সংস্থার কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারীকেও সেই সময় কাজে লাগানো হয়েছিল বলেও দাবী করেন তদন্তকারীরা।

গত বছর জুলাইয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের টালিগঞ্জ ও বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটে তল্লাসি চালিয়ে কোটি কোটি অঙ্কের টাকার পাহাড় উদ্ধার করেছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।স্তূপের আকারে সাজানো ছিল ৫০০ ও ২০০০ টাকার বান্ডিল বান্ডিল নোট। শুধু তাই নয় । সেখানে ছিল সোনার গয়না, সোনার বার, ভারী ভারী সোনার বালা এমনকি সোনার পেনও। এরপর তদন্ত প্রক্রিয়া যত এগিয়েছে, ততই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে। বেশ কিছু নথিও পাওয়া গিয়েছিল সেই ফ্ল্যাটে। যা থেকে ইঙ্গিত মিলেছিল পার্থ ও অর্পিতার যোগাযোগ ছিল ২০১২ সাল থকে। উভয়ের নামে একাধিক যৌথ সম্পত্তিরও হদিশ পেয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। ইডির দাবী অর্পিতা ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছেন যে উদ্ধার হওয়া সমস্ত টাকা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের।

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে একে একে জেল বন্দী হয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জি সহ মানিক ভট্টাচার্য(প্রাথমিক পর্ষদ সভাপতি), সুবীরেশ ভট্টাচার্য(প্রাক্তন এস এস সি চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য), কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়(প্রাক্তন সভাপতি পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদ), শান্তি প্রসাদ সিনহা(প্রাক্তন এসএসসি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি), অশোক সাহা (সেক্রেটারি WBCSSC), প্রসন্ন রায়-প্রদীপ সিংহ (মিডিল ম্যান), কুন্তল ঘোষ( যুব তৃণমূল নেতা), তাপস মণ্ডল( বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ সংগঠনের সভাপতি), চন্দন মণ্ডল ওরফে সৎ রঞ্জন এবং শেখ শাহিদ ইমাম(শিক্ষক)।

হুগলীর যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের কাছ থেকে উঠে এসেছে আরও দুই চক্রান্তকারীর নাম।তাদের মধ্যে একজন হলেন পেশায় শিক্ষক আরমান গঙ্গপাধ্যায় ওরফে গোপাল দলপতি আর আরেকজন তারই স্ত্রী মডেল অভিনেত্রী হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায়। গোপাল-হৈমন্তীর প্রায় ১২ টি সংস্থার মাধ‌্যমে পাচার হয়েছিল নিয়োগ দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা।ইতিমধ্যেই তাঁদের দুজনের নামে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির হদিশ পেয়েছেন তদন্তকারীরা বলে সুত্রের খবর। ইডির তদন্তকারীদের অনুমান শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির কালো টাকা দিয়েই এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি তারা ক্রয় করেছেন।
আদালতের নির্দেশে ওএমআর বিকৃতির কথা স্বীকার করে ৯৫২ জনের তালিকা তাঁদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিলো এসএসসি।যাঁদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতাও করছিলেন। আদালতের নির্দেশে কমবেশি ৬১৮ জনের চাকরি ইতিমধ্যেই বাতিল করেছে এসএসসি।

এই দিকে অযোগ্যদের চাকরি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হলেও মেয়ো রোডে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে বঞ্চিত যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলন প্রায় ৭১৮ দিনে পড়ল। নিজের ঘর ,পরিবার ,পরিজন, সন্তানদের ছেড়ে যুব সমাজকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে মমতা ব্যানার্জির পরিচালিত তৃণমূল সরকার ও তার সুপারিশ করা শিক্ষা দফতরের আধিকারিকরা। অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে মেধাবী যুব সম্প্রদায়কে। যে শিক্ষক মানুষ তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করে, সেই শিক্ষক পদকে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে কলুষিত করেছে গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে। এমনকি চিন্তিত করে তুলেছে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর অভিভাবকেও। এখনো পর্যন্ত দুর্নীতি মুক্তির কোন আশ্বাস দিতে ব্যর্থ হলেও অযোগ্যদের চাকরি বাঁচাতে অতি তৎপর এই তৃণমূল সরকার। বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা ছাত্রছাত্রী এবং শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বাংলার মানুষদের তাই একটাই প্রশ্ন…
‘চাকরিটা কবে মিলবে?’

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর