প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়, ৬ মার্চ: আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রতি বছরই আসে আর যায়। ৮ মার্চ ছুটিও ঘোষণা করা হয়। ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার এই দুটিই পেতে কয়েকশো বছর পেরিয়েছে। আর সম্পত্তির অধিকার এখনও নারীদের সমানভাবে দিতে বারে বারে হোঁচট খাচ্ছে সরকার। বারবার বিশ্বের বহু দেশকেই সংশোধন করতে হচ্ছে তাদের সংবিধান। এমন নয় যে বিশ্বের সব নেতারাই তাদের ঘরণীদের সমানাধিকারের কথা ভেবেছিলেন। বরং নেতাগিরি করতে করতেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। আর ঘরণীদের বোঝানো হয়েছিল, ‘আমি হীরকের রাজা ভগবান। ২৪ ঘণ্টা স্বামীর সেবা করাই তোমাদের কাজ’। ভারতে সেই কবে মুঘল যুগ থেকেই দুটো ভাত কাপড়ের আশায় স্বামী অন্তপ্রান হয়ে সেবা করে আসছেন ঘরণীরা। বাড়ির মেয়েরাও সেটাই শিখেছে। নয়তো জোর করে সেটাই সেখানো হয়েছে। মহিলারা পুরুষের মত চাকরি করতে বের হবে, এমন ভাবনা ৬০-এর দশকেও ছিল বিলাসিতা। মাঝে বামপন্থীরা সমান কাজের জন্য পুরুষ নারীর সমান বেতনের দাবিতে আন্দোলন করে নাড়িয়ে দিয়েছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভিত। যদিবা কোনও মহিলা তার অধিকারের জন্য গলা ফাটাত তবে সমাজে পুরুষেরা তুলত গেল গেল রব। একজন কাদম্বরী গাঙ্গুলি প্রথম ডাক্তার হয়েছিলেন তাতে বহু পুরুষই তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার ভয় পেয়েছিল।
নারীদের সমানাধিকার আজও যত বড়াই করে প্রচার করা হয়। বাস্তবে তার উল্টো ছবি দেখ যায়। নির্দিষ্ট কোনও পেশার উপযুক্ত করে তোলার দায় কোনও পুরুষই সে ভাবে খোলা মনে নিতে চায়না। আজ আর ভারত জুড়ে গরুর গাড়ির যুগ নেই। নেই মহিলাদের ওপর নিষ্পেষণের অধিকার। তবুও ভারতে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। মহিলাদের প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট মান পর্যন্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়নি। বহু মহিলাই অর্থাভাবে অথবা পরিস্থিতির চাপে স্কুল, কলেজ থেকে দুঃখজনকভাবে সরে আসছে। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও নারীশিক্ষার জন্য মাথা পিছু নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ হল না। অথবা তাদের বাধ্য করা হল না নির্দিষ্ট মান অবধি লেখা পড়া শেখার বিষয়ে। যদিবা কেউ শিখল তাকে চাকরি দেওয়ার গরজ নেই কারোর। হয় অর্থাভাবে পাড়ায় পাড়ায় টিউশানি করা অথবা দিন মজুর শ্রমিককে বিয়ে করে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থায় বাকি জীবন কাটাবেন। আজও কলকাতার শহরে বহু নারী নিজেদের সম্ভ্রম বেচতে বাধ্য হয়। পরিবারের মুখে অন্ন জোটাতে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও বহু কাজ করতে হয়। এমনকি শিক্ষিত মহিলাও পরিচারকের কাজ করে। অথচ সারা দেশে তো বটেই বিশেষত এবঙ্গে কমবেশি ২০ হাজার স্কুল বন্ধ। সেগুলি চালু থাকলে হাজার হাজার পরিবারের মহিলা স্বসম্মানে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারত।
নারীদের সাধারণত দয়া মায়া একটু বেশি। আর সেই সুযোগ কম নেয়নি পুরুষেরা। লিঙ্গ সমতার কথা বললেও আজও বিয়েতে যৌতুক নেওয়া বন্ধ হয়নি। এমনকি পণ্যের মত বিয়ের নামে আজও মহিলারা বাজারে বিক্রি হয়। গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষুধার অবসান ঘটানোর কথা কয়েক দশক আগে থেকে বলে আসছে সরকার। তবুও তো আমলাশোল হয়। পিঠে শিশু সন্তান বেঁধে মা রিক্সা চালায় বা ক্ষেতে কাজ করে। কিন্তু মজুরি পুরুষের চেয়ে তার কম। আজও বিজ্ঞাপনের বাজারে নারীরা পণ্য। স্বল্প পোষাকে নারীর ছবি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে পুরুষেরা। সিনেমা, থিয়েটার বা টিভি সিরিয়ালে স্বল্প পোশাকের নারীদের দেখলে টিআরপি বাড়ছে চড়চড় করে। এখনও কলকাতার পানশালাগুলিতে বারবনিতাদের নাচা- গানা দেখতে পুরুষেরা টাকা ওড়ায়। আর মুসলিম সমাজে এখনও পর্দানসীন প্রথা আর হিজাব পরার রেওয়াজ পুরদমে চলছে। এযেনও বন্দুক না দেখিয়ে চলছে তালিবানি প্রথা। তালাক প্রথাও ছিল নিন্দনীয়। কিন্তু জাতি -ধর্ম – বর্ণ- বংশভেদ না করেই সকল মহিলাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিলে সত্যিই বাঁচত তাদের পরিবার। গড়ে উঠত সুস্থ সমাজ। তৈরি হত শক্তিশালী দেশ। কিন্তু এত কথা ভাবে কে? সরকারই তো ভাবে না! আসলে সর্ষের মধ্যেই ভুত!