ব্যুরো নিউজ, ১৩ ফেব্রুয়ারি: পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগস্টে। সে দেশে প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হন মহঃ আলী জিন্না আদপে তিনি ছিলেন গুজরাটের বাসিন্দা। ভালো ইংরেজি জানতেন। কিন্তু উর্দুতে তার দখল ছিল না। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাস ছয়েক পরে ঢাকায় এসে একটি বক্তৃতা দেন। যেখানে বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা। তার এমন ধারনার পেছনে একটা কারনও ছিল। তিনি যাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন তারা ছিলেন এলিট সোসাইটির। তারা বুঝিয়ে ছিলেন পাকিস্তান উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিলে পৃথিবীর বহু দেশের সঙ্গে আদানপ্রদান সহজ হবে। কিন্তু বাস্তবটা তা ছিল না। সে সময় পাকিস্তানের প্রায় ৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৪ কোটিই ছিল বাংলা ভাষী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। ৯ দিনের পূর্ববঙ্গ সফরে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি বক্তৃতা দেন ১৯৪৮ এর ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরা অয়ারদি উদ্যান) স্পষ্ট করে বলেন, অন্য কোনও ভাষা নয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু। আর তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বাংলাভাষীরা। জিন্না অবশ্য হুমকি দেন, যারা ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে তারা পাকিস্তানের শত্রু। বলা হয়েছিল পাকিস্তানের প্রদেশগুলি সরকারী কাজে তাদের ভাষা ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু, রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।
ইংরেজি, হিন্দীর দৌরাত্ম্যে ‘একুশে জয়গান’
বাস্তবে দেখা গেল সে সময় সরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে উর্দু। যা বাঙালিরা জানতো না। ফলে প্রতিযোগিতায় তারা এঁটে উঠতে পারছিল না। এমনকি দেশের মুদ্রা, ডাক টিকিট, মানি অর্ডার, পোস্ট কার্ড, ট্রেনের টিকিট সবই হয় উর্দু না হয় ইংরেজিতে লেখা। প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। দেশের সামরিক বাহিনী ও সরকারী চাকরীতে অবাঙ্গালীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার কার্জন হলে জিন্নার ভাষণের পর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়। পরে জিন্নাকে স্মারকলিপি দেওয়া হয় যাতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির দাবি তোলা হয়। এই ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই গড়ে উঠেছিল সেদেশের ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। চাপে পড়ে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজ্রুল রহমান আশ্বাস দেন ডাক টিকিট, মুদ্রা প্রভৃতিতে বাংলা না থাকাটা নিতান্তই ভুল। বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের পূর্বাংশে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা তারা চুড়ান্ত ভাবে পিছিয়ে পরবে। এরপরেই শুরু হয় ভাষা নিয়ে আন্দোলনের ভীত গড়ার কাজ। কিন্তু জিন্না বলেন, উর্দু রাষ্ট্র ভাষা না হলে পাকিস্তানের ঐক্য, সঙ্গতি ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট হবে।
১৯৫৪ সালের ২১ দফা দাবিতে ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দৃঢ় যোগাযোগ ছিল। কিন্তু, পূর্ব-পাকিস্তানের বাংলা ভাষীদের দাবিই ছিল, পাকিস্তানের শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় কাজে প্রধান ভাষা বাংলা করতে হবে। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গনপরিষদে পাকিস্তানে উর্দু, ইংরাজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব আনেন কংগ্রেস সদস্য ঘীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু সে প্রস্তাব গনপরিষদ নাকোচ করে। প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্ররা ক্লাস বয়কট ও ধর্মঘট পালন করে। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় পালিত হয় ভাষা দিবস। ছাত্ররা দু’জন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। আন্দোলনকারী নেতাদের পুলিশ বেপরোয়া গ্রেফতার করে। তার মধ্যে ছিলেন সেখ মুজিবর রহমান, সামসুল হক, অলি আহাদের-সহ অনেকেই। সেখ মুজিবর ১৯৭১ এর মুক্তি যুদ্ধে অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি। গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ থেকে টানা ৩ দিন ঢাকায় ধর্মঘট হয়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় ছিল জিন্নার জেদে চুক্তি, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, স্মারকলিপি, সংসদে বিতর্ক সবই নিরর্থক হয়।
১৯৫২ সালে ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বক্তব্য রাখেন এবং উর্দুতেই শিলমোহর দেন। তার মতে দুটি রাষ্ট্রভাষায় কোনও দেশ অগ্রসর হতে পারেনা। ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেন তারা ১৪৪ ধারা ভাঙবেন। তাই সেই আন্দোলন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভরত ছাত্রদের দিকে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। ব্যপক সংখ্যায় গ্রেফতার করা হয়। এমনকি ছাত্রদের দিকে গুলিও চালানো হয়। আহতের সংখ্যা অগুনতি। হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় ৩ জনের, রফিক, আবুল, বরকত। আবার পরের দিন ২২ তারিখ গুলি চালায় পুলিশ। সব মিলিয়ে কত ছাত্রের মৃত্যু হয়েছিল তার সংখ্যা আজও অজানা। বাকিটা ভাষা শহিদ মঞ্চ তৈরি-সহ সবটাই ইতিহাস।