ব্যুরো নিউজ ২২ মে : নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘র্যাঙ্ক জাম্পিং’ বা মেধা তালিকা লঙ্ঘন করে চাকরি পাওয়ার ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট ফের কড়া অবস্থান জানাল। সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, যে সকল ব্যক্তি মেধা তালিকা অগ্রাহ্য করে বা অসঙ্গত উপায়ে উচ্চতর পদমর্যাদায় চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা আর নতুন করে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না। এই রায় পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের (WBSSC) নিয়োগ দুর্নীতিতে চাকরি হারানো ‘র্যাঙ্ক জাম্পার’দের ক্ষেত্রেও সরাসরি প্রভাব ফেলবে এবং তাদের পরীক্ষায় বসার সুযোগ নাকচ করে দেবে।
আদালতের কড়া বার্তা: মেধা লঙ্ঘনের ফল
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের একটি বেঞ্চ আজ এই গুরুত্বপূর্ণ রায় ঘোষণা করে। আদালত তার পর্যবেক্ষণে জানায়, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মেধার ক্রম (rank) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো ব্যক্তি তাঁর প্রাপ্য মেধার চেয়ে উচ্চতর পদে অথবা মেধা তালিকা লঙ্ঘন করে চাকরি পান, তবে তা সামগ্রিক নিয়োগ ব্যবস্থার প্রতি অবিচার। এই ধরনের ‘র্যাঙ্ক জাম্পিং’ পদ্ধতিকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধের জন্য কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছে।
WBSSC নিয়োগ দুর্নীতি এবং সুপ্রিম কোর্টের পূর্বের রায়
সম্প্রতি, পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের (WBSSC) নিয়োগ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত দুর্নীতিতে তোলপাড় হয়েছে রাজ্য। সুপ্রিম কোর্ট এর আগে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করেছিল, যার ফলে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি গিয়েছিল। এদের মধ্যে অনেকেই ‘র্যাঙ্ক জাম্প’ করে চাকরি পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ ছিল।
চাকরি হারানো সেইসব প্রার্থীরা ফের চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার আবেদন নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তবে শীর্ষ আদালত আজ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না যে রায় দিয়েছিলেন তা সঠিক এবং আদালত আর এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট এর আগেই নির্দেশ দিয়েছিল যে, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষকরা স্কুলে যেতে পারবেন এবং বেতনও পাবেন। তবে যাঁরা অযোগ্য, তাঁদের বেতন ফেরত দিতে হবে এবং চাকরির পরবর্তী পরীক্ষাতেও তাঁরা বসতে পারবেন না। এই অযোগ্যদের তালিকাতেই তাঁরা ছিলেন যাঁরা ‘র্যাঙ্ক জাম্প’ করে চাকরি পেয়েছিলেন।
‘সাদা খাতা’ জমা না দেওয়া সত্ত্বেও কেন আবেদন খারিজ?
‘র্যাঙ্ক জাম্প’ করে চাকরি হারানো ওই শিক্ষকরা আদালতে আবেদন করেছিলেন যে, তাঁরা সাদা খাতা জমা দেননি এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণও করেছিলেন। তাঁদের নাম প্যানেলেও ছিল, তাই তাঁদের ফের পরীক্ষায় বসতে দেওয়া উচিত।
তবে বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং বিচারপতি কেবি বিশ্বনাথনের ডিভিশন বেঞ্চ এই আর্জি গ্রহণ করেননি। তাঁরা স্পষ্ট জানান, ‘র্যাঙ্ক জাম্পিং’ও এক ধরনের দুর্নীতি। সেই কারণে এই ধরনের ব্যক্তিদের পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
কেন এই রায়?
নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঘিরে বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, মেধা তালিকায় পিছিয়ে থাকা বা যোগ্যতাহীন প্রার্থীরা প্রভাব খাটিয়ে বা অবৈধ উপায়ে উচ্চ পদমর্যাদার চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন—এমন অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টের নজরে এসেছে। এই প্রবণতা কেবল যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে না, বরং পুরো নিয়োগ ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করে। আজকের রায় সেইসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই দেওয়া হয়েছে, যেখানে মেধা লঙ্ঘনের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
নিয়োগকর্তা এবং প্রার্থীদের উপর প্রভাব
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিয়োগকারী সংস্থা এবং চাকরিপ্রার্থী উভয় পক্ষের উপরই সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
নিয়োগকারী সংস্থা: সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতেই নিয়োগকারী সংস্থাগুলিকে মেধা তালিকা প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে। যেকোনো ধরনের মেধা লঙ্ঘনের ঘটনা গুরুতর আইনি জটিলতা তৈরি করতে পারে। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত করতে তাদের দায়বদ্ধতা বাড়বে।
চাকরিপ্রার্থী: এই রায় যোগ্য ও পরিশ্রমী প্রার্থীদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। এটি নিশ্চিত করবে যে, কেবল মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই চাকরি মিলবে, কোনো রকম অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে নয়। তবে, যারা মেধা লঙ্ঘন করে চাকরি পেয়েছেন, বিশেষ করে WBSSC দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ‘র্যাঙ্ক জাম্পার’রা, তাদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। তাদের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা তো থাকছেই, উপরন্তু ভবিষ্যতে অন্য কোনো নিয়োগ পরীক্ষায় বসার সুযোগও তারা পাবেন না।
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ এবং প্রত্যাশা
এই রায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করবে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। এটি অনিয়ম দূর করে মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়তা করবে। আশা করা হচ্ছে, এই রায়ের পর বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাদের নিয়োগ নীতি ও পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনোভাবেই ‘র্যাঙ্ক জাম্পিং’ বা মেধা লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটে।