ইভিএম নিউজ ব্যুরো, ১৯ মার্চঃ সেটিং। পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ।অতীত হোক আর বর্তমান, বিভিন্ন ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্যসরকারের এই সেটিংয়ের অভিযোগ বহুবার সামনে এনেছেন বিরোধীরা। কিন্তু সম্প্রতি ওঠা মমতার সঙ্গে সিবিআই আধিকারিকদের একাংশের সেটিং তত্ত্ব অবাক করেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও।
পরিসংখ্যান বলছে,সাম্প্রতিক অতীতে সারদা- রোজভ্যালি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেআইনি লগ্নিকারী সংস্থাগুলির প্রতারণা মামলার তদন্তে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও বাবরি মসজিদ ধ্বংস , আরুষি তলোয়ার হত্যা, সুশান্ত সিং রাজপুত মৃত্যু রহস্যের মামলাতেও সিবিআইয়ের ব্যর্থতার নজির রয়েছে ।কিন্তু সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও গরু পাচার মামলায় তদন্ত দীর্ঘায়িত হওয়া এবং সর্বশেষ বগটুই কাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রী লালন শেখের সিবিআই হেফাজতে মৃত্যুর পর ভারতের এই প্রধান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় ৩২ জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দিয়ে লখনউয়ের বিশেষ আদালত কার্যত সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। ওই মামলার বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদবের মতে, বাবরি-কাণ্ডে সিবিআইয়ের প্রধান তদন্তকারী অফিসার মসজিদ ভাঙার পিছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র প্রমাণের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণই হাজির করতে ব্যর্থ। সেই সময় সিবিআইয়ের তরফ থেকে আদালতে কেবল মাত্র কিছু রাজনৈতিক নেতানেত্রী ও হিন্দু সংগঠনগুলোর ৪৯ জন সদস্যের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা প্রকৃত হামলাকারী, তাদের অভিযুক্ত করা হয়নি। শুধু সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবই নয়, সিবিআই তদন্ত ফৌজদারি দণ্ডবিধি মেনে হয়নি বলেও আদালত স্পষ্ট রায় দিয়েছিলো।
২০০৪ সালের ২৫ শে মার্চ বীরভূমের শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি হয়। তারপর কেটে গিয়েছে ১৯ বছর কিন্তু এখন পর্যন্ত তদন্তে কোনও সাফল্য পায়নি সিবিআই।এই মর্মে ২০১৭-তে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা হলে সেই মামলার শুনানিতে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রাকেশ তিওয়ারি সিবিআইকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেন, “নোবেল আমাদের জাতীয় সম্পদ। অথচ তা উদ্ধারের জন্য সে অর্থে কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ এখনও নিতে পারেনি সিবিআই। কেন আপনারা কিনারা করতে পারলেন না এত বছরেও?”
২০০৮ সালের ১৬ই মে নাবালিকা আরুষি তলোয়ারের মৃত দেহ নয়ডার একটি আবাসন থেকে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার হয়। প্রথমে বাড়ির পরিচারক হেমরাজকে সন্দেহ করা হলেও পরে তাঁর দেহ ওই একই আবাসনের ছাদ থেকে উদ্ধার হলে শেষ পর্যন্ত আরুষির বাবা রাজেশ তলোয়ার ও মা নুপূর তলোয়ারকে জোড়া খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে নিম্ন আদালত। ২০১৩ সালে রাজেশ ও নূপুর তলোয়ারকে গাজিয়াবাদের সিবিআই আদালত এই খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডের নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি প্রমাণ নষ্ট ও তদন্তকে বিপথে চালিত করার জন্যও তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এরপর তাঁরা এলাহাবাদ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেয় ওই চিকিৎসক দম্পতিকে।
২ জি দুর্নীতি কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও ধরা পড়েছে একই চিত্র। প্রায় ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকার টুজি কেলেঙ্কারির তদন্ত করেছিল সিবিআই। কিন্তু প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যান তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা এবং ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি করুনানিধি। এক্ষেত্রেও অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয় সিবিআই।এই ঘটনাতেও শীর্ষ আদালতের তীব্র ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছিল সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারদের।
সাম্প্রতিককালে সিবিআইয়ের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু মামলা। ২০২০ সালের ১৪ জুন বান্দ্রার কার্টার রোডের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় সুশান্তের ঝুলন্ত দেহ। আত্মহত্যা না খুন? কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল অভিনেতার? – তা জানার জন্য প্রথম থেকেই সিবিআই তদন্তের দাবি উঠেছিল গোটা দেশে। পরিবারেরও একই ইচ্ছে ছিল।সেই মতো এই দাবী বিহার সরকারের অনুমোদনে পৌঁছে গিয়েছিল শীর্ষ আদালত পর্যন্ত। সম্মতি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারেরও। অভিনেতার মৃত্যুর চৌষট্টি দিনের মাথায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এই ঘটনার পর আড়াই বছর কেটে গেলেও আজও সুশান্ত মৃত্যু রহস্যের প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে ব্যর্থ সিবিআই।
অতীতের বিভিন্ন মামলায় সিবিআই-এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা গিয়েছে বিরোধীদের। কিন্তু কয়েকদিন আগে বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষের ইডিকে সিবিআই-এর চেয়ে বেশি বিশ্বস্ত বলা এবং সম্প্রতি সারদা মামলায় মমতার বিরুদ্ধে তদন্তে সিবিআইয়ের অনীহা প্রকাশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লেখা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর চিঠি , মমতা- সিবিআই সেটিং তত্ত্বের জল্পনাকে আরও একবার উস্কে দিলো।