রাহুল কর্মকার, বাঁকুড়া, ২১ জানুয়ারিঃ স্কুলে এসেছিলেন ‘দিদির দূত’। তিনি আবার রাজ্যের শাসকদলের সাংসদ। আর তাঁকেই কিনা মহার্ঘ্য ভাতা সরকার কবে দেবে, সেই নিয়ে প্রশ্ন করা? একজন সামান্য মাসমাইনের শিক্ষক হয়ে, এত বড় দুঃসাহসিক প্রশ্ন করার সাজা মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যেই পেয়ে গেলেন, বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের জেনাডিহি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাক্ষীগোপাল মণ্ডল। শুক্রবার দিদির সুরক্ষা কবচ কর্মসূচির প্রচারে বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটির স্কুলে গিয়েছিলেন, তৃণমূল সাংসদ মালা রায়। সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখা গেছে, ‘দিদির দূত’-কে কাছে পেয়ে, রাজ্যসরকার তার কর্মচারীদের ডিএ দেওয়ার বিষয় কী ভাবছে, সেই প্রশ্ন করেন, জেনাডিহি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাক্ষীগোপাল মণ্ডল। ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিও দেখা গেছে, একজন প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গত প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে, দৃশ্যতই প্রথমে অস্বস্তিতে এবং তারপর উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তৃণমূল সাংসদ মালা রায়। সামনে দাড়িয়ে থাকা প্রধানশিক্ষকের উদ্দেশ্যে উল্টোদিকে চেয়ারে বসে থাকা তৃণমূল সাংসদ রীতিমতো ধমকের সুরে বলেন, “আপনি ব্যক্তিগত স্বার্থে ডিএ চাইছেন। আর সরকার রাজ্যের সমস্ত স্কুলপড়ুয়াদের স্বার্থের কথা ভাবছে। তাহলে আপনিই বলুন কাদের স্বার্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?”
এখানেই শেষ নয়। স্কুলের মিড ডে মিল, শিক্ষকশিক্ষিকাদের যাওয়া-আসার সময়, এবং স্কুলে পড়ে থাকা একটি জলের ফিল্টার নিয়েও, এরপর একের পর এক অভিযোগ করতে শুরু করেন, তৃণমূল সাংসদ মালা রায়।
ওদিকে শাসকের চোখে চোখ রেখে সঙ্গত একটি প্রশ্ন করে, তিনি যে আসলে শাসককেই রুষ্ট করে ফেলেছেন, মুহূর্তেই তা বুঝে কিছুটা জড়সড় হয়ে যান, ওই প্রধানশিক্ষক। কিন্তু রাজনৈতিক ডিপ্লোম্যাসির ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে, এরপর আরও এক কাণ্ড করে বসেন, তৃণমূল থেকে কংগ্রেসের গিয়েও, আবার তৃণমূলে ফিরে আসা মালা রায়। সরকারি প্রকল্পের প্রচারে যাওয়া মালার সঙ্গে, স্কুলের মধ্যে ঢুকে পড়া স্থানীয় ব্লক তৃণমূল সভাপতি ও অন্যান্য কর্মীদের উদ্দেশ্যে, রীতিমতো গম্ভীর সুরে নির্দেশ দিয়ে সাংসদ বলেন, “এই স্কুলের দিকে এরপর থেকে নজর রাখতে হবে”।
যেমন কথা তেমন কাজ। শুক্রবার দুপুরের ওই ঘটনার ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়েই জেলা প্রাথমিক শিক্ষাসংসদের জনৈক কর্তাকে, নিজের মোবাইল থেকে রীতিমতো নির্দেশের ভঙ্গিতে ব্লক তৃণমূল সভাপতি বলছেন, “সরকার এত কিছু করছে, তারপরেও এঁরা এই অসভ্যতা করবে কেন? আজ বিকেলের মধ্যেই আপনি এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিন। এটা আমি দেখতে চাই, যে একশন নিয়েছেন আপনি অ্যাকশন নিয়েছেন”।
শাসকদলের স্থানীয় ওই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার নির্দেশ অমান্য করার সাহস অবশ্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সংশ্লিষ্ট এই কর্তা দেখাননি। ‘নির্দেশ’-এর কয়েকঘণ্টার মধ্যে, শুক্রবার বিকেলেই এই ‘বেআক্কেলে’ প্রশ্ন করার জন্য শোকজ এর বার্তা পৌঁছে গেল, জেনাডিহি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাক্ষীগোপাল মণ্ডলের কাছে। আর সরকারি নির্দেশ মেনেই, সেই শোকজ এর শুনানিতে হাজিরা দিতে, শনিবার সকাল-সকাল বাঁকুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের অফিসে সশরীরে পৌঁছে গেলেন, সাক্ষীগোপাল মণ্ডল।
যদিও, বাঁকুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষাসংসদের তরফে জানানো হয়েছে, জেনাডিহি হাইস্কুলের ওই প্রধান শিক্ষক স্কুলে নিয়মিত আসতেন না— অভিযোগেই তাঁকে শোকজ করা হয়েছে। তবে ওই প্রধান শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, শিক্ষকদের বামপন্থী সংগঠনের সদস্য হওয়ার কারণে, দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় শাসকদলের কিছু নেতা এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষাসংসদের একশ্রেণীর তৃণমূল সমর্থক পদাধিকারীর সঙ্গে তাঁর ঠান্ডা লড়াই চলছিল। এদিনের শোকজের ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ।
